আনলিমার শেয়ারে কারসাজি কোটি টাকার ওপরে, জরিমানা লাখে

কৃত্রিমভাবে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ানোর অভিযোগে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তিন ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে এ জরিমানা করেছে।

শেয়ারবাজার

শেয়ারবাজারেতালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি আনলিমা ইয়ার্নের শেয়ারদর নিয়ে কারসাজির দায়ে তিন ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত মাসে এ জরিমানা করে।

সম্প্রতি বিএসইসির ওয়েবসাইটে জরিমানার আদেশটি প্রকাশ করা হয়েছে। তা থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের ২৮ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৬ কর্মদিবস কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে এই কারসাজির ঘটনা ঘটে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তদন্তে কারসাজির ঘটনাটি উদ্‌ঘাটিত হয়।

ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কারসাজির সঙ্গে জড়িত তিন ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে বিএসইসি। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন সিফাত মাহমুদ আবদুল্লাহ, তাঁর বাবা আবুল কাশেম ভূঁইয়া ও মা শাহানারা আকতার চৌধুরী। আর প্রতিষ্ঠানটি হলো সিফাত মাহমুদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট, নাম কেটিএস ফ্যাশনস।

আমাদের বাজারে বেশির ভাগ কারসাজির ঘটনার বিরুদ্ধেই কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সে বিবেচনায় এবারের জরিমানা অন্তত মন্দের ভালো।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সিফাত মাহমুদকে ৩৫ লাখ, তাঁর বাবা আবুল কাশেম ভূঁইয়াকে ২০ লাখ ও মা শাহানারা আকতার চৌধুরীকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সিফাত মাহমুদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কেটিএস ফ্যাশনসকে জরিমানা করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা।

সিফাত মাহমুদের লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্রোকারেজ হাউস সূত্রে জানা যায়, কারসাজির কারণে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হলেও সবগুলো বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব পরিচালনা করতেন সিফাত নিজেই। অর্থাৎ নিজের মা-বাবা ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিও হিসাব খুলে সেগুলো ব্যবহার করে সিফাত নিজে আনলিমা ইয়ার্নের শেয়ারের সিরিজ লেনদেন করেন। সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, সিরিজ লেনদেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সিরিজ লেনদেন হলো মূলত নিজেদের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচা করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর একটি ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় নিজেদের এক বিও হিসাব থেকে অন্য হিসাবে বেশি দামে শেয়ার কেনা হয়। এভাবে শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়। আর মূল্যবৃদ্ধির একপর্যায়ে গিয়ে সব শেয়ার বিক্রি করে বড় অঙ্কের মুনাফা তুলে নেন কারসাজিকারকেরা।

আনলিমা ইয়ার্নের শেয়ারের কারসাজি-সংক্রান্ত ডিএসইর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিফাত মাহমুদ ও তাঁর সহযোগীরা কারসাজির মাধ্যমে ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা মুনাফা করেছেন। আর আন রিয়ালাইজড মুনাফা (শেয়ার বিক্রি করে যে মুনাফা তুলে নেওয়া হয়নি) করেছেন প্রায় ২১ লাখ টাকা।

অর্থাৎ সব মিলিয়ে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মুনাফা হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা। এ জন্য কারসাজিকারকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করে বিএসইসি। আর তাঁদের জরিমানা করা হয় ৭০ লাখ টাকা। শুনানিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে জরিমানা মওকুফ চান। তবে বিএসইসি তাঁদের সেই আবেদন গ্রহণ করেনি।

এদিকে বিশ্লেষকদের অভিমত, কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে কারসাজিকারকেরা যে মুনাফা করেন, তার তুলনায় কম জরিমানা করা হলে তাতে বাজারের কোনো লাভ হয় না। কারণ, কারসাজিকারকেরা তখন মনে করেন কারসাজির মাধ্যমে বড় অঙ্কের মুনাফা করে অল্প জরিমানা দিয়ে পার পাওয়া সম্ভব। তাই তাঁরা কারসাজিতে আরও বেশি উৎসাহিত হন।

এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি কোনো কারসাজির ঘটনা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়, তাহলে কারসাজিকারক যে মুনাফা করেছেন, তার চেয়ে জরিমানা কোনোভাবেই কম হওয়া উচিত নয়। তবে আমাদের বাজারে বেশির ভাগ কারসাজির ঘটনার বিরুদ্ধেই কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সে বিবেচনায় এবারের জরিমানা অন্তত মন্দের ভালো।’ 

ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিফাত মাহমুদ ও তাঁর মা-বাবা এবং প্রতিষ্ঠান কারসাজির ঘটনা ঘটাতে ৩৬ কার্যদিবসে বাজার থেকে আনলিমা ইয়ার্নের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনেছেন।

কিন্তু সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একক বা সংঘবদ্ধভাবে বাজার থেকে কোনো কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনলে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সেটি ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু সিফাত মাহমুদরা সেই ঘোষণা দেননি। সুতরাং তাঁরা যা করেছেন, তা সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী অপরাধ।