শেয়ারবাজার কেন উল্টো পথে হাঁটছে

ঋণসুবিধা বাড়ানো হলেও ডিএসইতে গতকাল মূল্যবৃদ্ধিতে বন্ধ, দুর্বল ও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে না পারা কোম্পানিগুলোর প্রাধান্য ছিল।

শেয়ারবাজার
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে ভালো মানের কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ঋণসুবিধা বাড়িয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সংস্থাটির নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি টানা তিন বছর ধরে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত রয়েছে, সেগুলোর শেয়ারে ৫০ মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) পর্যন্ত ঋণসুবিধা মিলবে। আগে এসব শেয়ারে ৪০ পিই রেশিও পর্যন্ত ঋণসুবিধা মিলত। তবে যেসব কোম্পানির শেয়ার কেনায় বাড়তি ঋণসুবিধা পাওয়া যাবে, সেগুলোর ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন হতে হবে ৩০ কোটি টাকা।

মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন, কোনো একটি কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য ১০০ টাকা। আর ওই কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস ১০ টাকা। তাহলে কোম্পানিটির মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) দাঁড়াবে ১০। শেয়ারের বাজারমূল্যকে আয় দিয়ে ভাগ করে মূল্য আয় অনুপাত হিসাব করা হয়। বিএসইসির নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই কোম্পানির শেয়ারের দাম ৫০০ টাকা অতিক্রম না করা পর্যন্ত তা কেনার জন্য ঋণসুবিধা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। এত দিন এই ঋণসুবিধা ৪০ পিই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। তাতে শেয়ারের দাম ৪০০ টাকা অতিক্রম না করা পর্যন্ত ঋণসুবিধা পেতেন বিনিয়োগকারীরা।

ভালো শেয়ারে ঋণসুবিধা বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত বিএসইসি নিয়েছে, সেটির সঙ্গে আমি নীতিগতভাবে একমত। তবে আমার মনে হয়, ভুল সময়ে এ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। কারণ, বাজারে বেশির ভাগ ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসের কারণে স্থবির হয়ে আছে। এসব কোম্পানিকে লেনদেনে ফেরানোর আগেই সেখানে ঋণসুবিধা বাড়ানো হয়েছে।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি।

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ভালো মানের ৩০ কোম্পানি নিয়ে ডিএস-৩০ নামে আলাদা একটি সূচক রয়েছে। এ সূচকে অন্তর্ভুক্ত ৩০টি কোম্পানি শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানি বা ব্লু চিপ শেয়ার হিসেবে পরিচিত। বিএসইসি ঋণসুবিধা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা।

ঢাকার শেয়ারবাজারে গতকাল রোববার মূল্যবৃদ্ধির তালিকাটি পর্যালোচনা করলেই উল্টো চিত্রটি বোঝা যাবে। এদিন ডিএসইতে মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ কোম্পানি ছিল খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, মিডল্যান্ড ব্যাংক, হাওয়েল টেক্সটাইল, সেন্ট্রাল ফার্মা, ইয়াকিন পলিমার, অগ্নি সিস্টেমস, মাইডাস ফাইনান্সিং, এক্‌মি ল্যাবরেটরিজ ও জেমিনি সি ফুড।

ডিএসইর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে থাকা খান ব্রাদার্স পিপি ওপেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনছে। বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত লভ্যাংশও দিতে পারে না কোম্পানিটি। সর্বশেষ ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরের জন্য তারা মাত্র ২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আর মূল্যবৃদ্ধির দ্বিতীয় স্থানে থাকা সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৯ সালের পর থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে তো কোম্পানিটির উৎপাদনই বন্ধ রয়েছে।

স্বল্প মূলধনি ও খারাপ মানের যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে, সেগুলোকে আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি। আনুষ্ঠানিক তদন্তের আগে আমরা এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি না, সেই তথ্য সংগ্রহ করছি। এসব তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মোহাম্মদ রেজাউল করিম, মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক, বিএসইসি।

সেন্ট্রাল ফার্মা সর্বশেষ ২০১৯ সালে বিনিয়োগকারীদের ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। ইয়াকিন পলিমারও ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি। সর্বশেষ ২০২০ সালে কোম্পানিটি ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল বিনিয়োগকারীদের। অগ্নি সিস্টেমসও ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি। এটি ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের সাড়ে ৪ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। মাইডাস ফাইন্যান্সিং সর্বশেষ ২০২১ সালের জন্য নগদ ও বোনাস মিলিয়ে ২ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল বিনিয়োগকারীদের।

এর বাইরে মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় প্রথম দিকে থাকা মিডল্যান্ড ব্যাংক নতুন তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান। হাওয়েল টেক্সটাইল, এক্‌মি ল্যাবরেটরিজ ও জেমিনি সি ফুড ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি হলেও কোনোটিই ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর জন্য গঠিত ডিএস-৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব কোম্পানির মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণও নেই। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কারসাজি ও নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে মানহীন অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। অথচ ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ার আটকে আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইসে।

ডিএস-৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে গতকাল ২০টিরই দাম অপরিবর্তিত ছিল। এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অনেক দিন ধরেই মূলত ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। এ সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে গতকাল মাত্র ৫টির দাম বেড়েছে, ৪টির দাম কমেছে। আর একটির কোনো লেনদেন হয়নি। যখন ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম ও হাতবদলের অবস্থা এ রকম, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে এ শ্রেণির শেয়ারে ঋণসুবিধা বৃদ্ধির সুফল কারা নিচ্ছে; নাকি বিএসইসির নেওয়া এ সিদ্ধান্তকে কাজে লাগিয়ে বাজারে আবারও কারসাজিকারকেরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন?

আরও পড়ুন

বাজারে কিছু কোম্পানির শেয়ারের সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কারসাজিকারকদের সক্রিয় হওয়ারই ইঙ্গিত দেয়। কারণ, এসব কোম্পানির দাম কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো জেমিনি সি ফুড। কোম্পানিটির শেয়ারের দাম তিন মাসে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারিও কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৪৯৭ টাকা, যা গতকাল বেড়ে হয়েছে ৯৩৪ টাকা। তাতে তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৪৩৭ টাকা বা ৮৮ শতাংশ বেড়েছে। এ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছেন না বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী জানান, স্বল্প মূলধনি কোম্পানি হওয়ায় বেশ কিছুদিন ধরে একটি গোষ্ঠী কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটাচ্ছে। তিন মাসে এটির শেয়ারের দাম দ্বিগুণ হলেও বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থাই আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ডিএসইর পক্ষ থেকে অবশ্য কোম্পানিটির কাছে একবার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। জবাবে যথারীতি কোম্পানিটি জানিয়েছে, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ তাদের জানা নেই। এমনকি মূল্য বাড়তে পারে এমন কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্যও তাদের হাতে নেই।

আরও পড়ুন

ভালো শেয়ারের বদলে মাঝারি ও খারাপ মানের শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি চুপ কেন বা কী করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্থাটির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেমিনি সি ফুডসহ স্বল্প মূলধনি ও খারাপ মানের যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে, সেগুলোকে আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি। আনুষ্ঠানিক তদন্তের আগে আমরা এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি না, সেই তথ্য সংগ্রহ করছি। এসব তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিএসইসি যখন ভালো শেয়ারে ঋণসুবিধা বাড়িয়েছিল, তখন এর কারণ হিসেবে বলেছিল, ভালো শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাজারে তারল্য সরবরাহ বৃদ্ধি, জোরপূর্বক বিক্রি বা ফোর্সড সেল বন্ধ করা ছিল বিএসইসির উদ্দেশ্য। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেটা নিয়ে সন্দিহান বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাজারসংশ্লিষ্ট অনেকেই।

আরও পড়ুন

জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভালো শেয়ারে ঋণসুবিধা বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত বিএসইসি নিয়েছে, সেটির সঙ্গে আমি নীতিগতভাবে একমত। তবে আমার মনে হয় ভুল সময়ে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। কারণ, বাজারে বেশির ভাগ ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসের কারণে স্থবির হয়ে আছে। এসব কোম্পানিকে লেনদেনে ফেরানোর আগেই সেখানে ঋণসুবিধা বাড়ানো হয়েছে। যেহেতু কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম আটকে আছে, তাই কেউ বাড়তি ঋণ নিয়ে ওই সব শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন না; বরং যেসব শেয়ারের দাম বাড়ছে, সেখানেই বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। এ কারণে সিদ্ধান্তটি ভালো হলেও তা ভুল সময়ে নেওয়ায় কাজ করছে না।

আরও পড়ুন