পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে ঋণ, সুফল মিলবে কি

শেয়ারবাজার
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

শেয়ারবাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে ঋণ হিসেবে ব্যবহার হবে বিনিয়োগকারীদের অদাবিকৃত বা অবণ্টিত (আনক্লেইমড) লভ্যাংশের অর্থ। বিনিয়োগকারীদের অদাবিকৃত লভ্যাংশের অর্থে গঠিত পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল (সিএমএসএফ) থেকে তারল্য বাড়াতে এ ঋণসহায়তা দেওয়া হবে। সম্প্রতি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করেছে।

বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী, পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিল থেকে শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংককে তারল্য জোগান দেওয়া যাবে।

আরও পড়ুন
কয়েক শ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলে তাতে বাজারে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। এর আগেও তহবিলটি থেকে বিনিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু বাজারে তার কোনো প্রভাব আমরা দেখিনি
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি

বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনার জন্য মার্জিন বা প্রান্তিক ঋণ দিতে এ তারল্য জোগান দেওয়া যাবে। বিনিয়োগকারীদের মার্জিন সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে নিজেদের পত্রকোষ বা পোর্টফোলিওর মাধ্যমেও বিনিয়োগ করতে পারবে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণের সমপরিমাণ অর্থ নিজেদেরও বিনিয়োগ করতে হবে। বিএসইসি বলছে, সিএমএসএফ থেকে দেওয়া ঋণের সুদ ব্যাংকের মেয়াদি আমানত বা এফডিআরের তিন মাসের গড় সুদের কম হতে পারবে না। তহবিল থেকে দেওয়া ঋণের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ১৮০ দিন বা ছয় মাস। তবে মেয়াদ নবায়নের সুযোগ থাকবে।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিএমএসএফ থেকে ঋণ দেওয়ার এ উদ্যোগের খুব বেশি সুফল মিলবে বলে মনে হয় না। কারণ হিসেবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, বর্তমানে ব্যাংক থেকে ৭-৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে তা তাঁরা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণ করতে পারছেন। কিন্তু সিএমএসএফ তহবিল থেকে দেওয়া ঋণের সুদকে বলা হচ্ছে সর্বোচ্চ মেয়াদি ঋণের তিন মাসের গড় হারকে। বর্তমানে অনেক ব্যাংক ৮ শতাংশ সুদেও মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। সেটিকে যদি সর্বোচ্চ সুদ বিবেচনায় নিয়ে সুদহার নির্ধারণ করা হয়, তাহলে কোনো ব্রোকারেজ হাউস ঋণ নিতে আগ্রহী হবে না।

আরও পড়ুন

ব্রোকারেজ হাউসের অপর এক নির্বাহী বলেন, বর্তমানে বাজারে ভালো মানের কোম্পানিগুলোর শেয়ারেরই কোনো ক্রেতা নেই। এ অবস্থায় নতুন করে ঋণ নিয়ে এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করলে সেই শেয়ার বিক্রি করা যাবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা করতে না পারলে ঋণের সুদ পরিশোধ করব কীভাবে?  

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ উদ্যোগ বাজারে বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। কারণ তহবিলের আকার কয়েক শ কোটি টাকার। এ টাকা থেকে ঋণ দিয়ে বাজারকে গতিশীল করা খুব কঠিন। ইতিমধ্যে তহবিলটি থেকে দুই শ কোটি টাকার বেশি বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাতে বাজার পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি।

বিএসইসির নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে একসঙ্গে ২০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। আবার একসঙ্গে ৫ কোটি টাকার কম ঋণও দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া যেসব ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের সমন্বিত গ্রাহক হিসেবে ঘাটতি রয়েছে এবং গত পাঁচ বছরের মধ্যে যেকোনো ধরনের শাস্তি পেয়েছে, সেসব ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক তহবিল থেকে তারল্য সুবিধা পাবে না।

আরও পড়ুন

সিএমএসএফ গঠিত হয় ২০২১ সালে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা লভ্যাংশ বাবদ বিনিয়োগকারীদের অদাবিকৃত অর্থে এ তহবিল গঠন করা হয়। তহবিলের অর্থ বিনিয়োগকারীদের ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে এ-সংক্রান্ত আইনে। এরই মধ্যে তহবিল থেকে ৫০ কোটি টাকা দিয়ে গঠন করা হয়েছে একটি মিউচুয়াল ফান্ড।

সিএমএসএফ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তহবিলে বর্তমানে সব মিলিয়ে নগদ অর্থ রয়েছে ৫১০ কোটি টাকা। আর ৬৫০ কোটি টাকার সমমূল্যের বোনাস বা স্টক লভ্যাংশ রয়েছে। এসব নগদ অর্থ ও বোনাস শেয়ার তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অবিতরণকৃত লভ্যাংশ থেকে তহবিলে জমা হয়েছে।

সিএমএসএফের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তহবিলে থাকা নগদ অর্থের মধ্যে ২২৫ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা আইসিবির মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর ৫০ কোটি টাকায় গঠন করা হয়েছে একটি মিউচুয়াল ফান্ড।

মনোয়ার হোসেন আরও বলেন, শেয়ারবাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে ঋণসহায়তা দিতে বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী একটি খসড়া নীতিমালাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। সিএমএসএফের বিভিন্ন কমিটিতে আলাপ-আলোচনার পর এ খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে। এরপরই সেই অনুযায়ী ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হবে।

বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়েছে, তহবিলের আকারের ৫ শতাংশের বেশি কোনো একক গ্রাহককে ঋণ হিসেবে দেওয়া যাবে না। তহবিল থেকে দেওয়া ঋণের অর্থ ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবে ঋণগ্রহীতা ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। ঋণ নিয়ে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তা যথাযথভাবে বিনিয়োগ করছে, সেই তথ্য প্রতি মাসে সংগ্রহ করবে সিএমএসএফ কর্তৃপক্ষ।

তবে তহবিল থেকে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার আগে যথাযথভাবে ঋণঝুঁকি বিবেচনা করতে বলা হয়েছে বিএসইসির নির্দেশনায়।  

এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে তারল্য বাড়াতে বিএসইসি যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি ঠিকই আছে। কিন্তু তহবিল থেকে কয়েক শ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলে তাতে বাজারে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। এর আগেও তহবিলটি থেকে বিনিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু বাজারে তার কোনো প্রভাব আমরা দেখিনি।’