‘ব্লক মার্কেটে’ বিশেষ চক্র, কী হচ্ছে দেখছে না কেউ

বাজারে কম দামে কেনাবেচার সুযোগ থাকার পরও কিছু শেয়ার বেশি দামে কেনাবেচা হচ্ছে ব্লক মার্কেটে। তাই এ ধরনের লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

৮ সেপ্টেম্বর রোববার। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল বাজারে তালিকাভুক্ত সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের লাখ লাখ শেয়ারের বিক্রয়াদেশ দিয়ে বসে আছেন অসংখ্য বিনিয়োগকারী। কিন্তু বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের কোনো ক্রেতা নেই। এই শেয়ারের দাম নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ফ্লোর প্রাইস ১০ টাকা ২০ পয়সা।

মূল বাজারে ফ্লোর প্রাইসে লাখ লাখ শেয়ার বিক্রি করতে চেয়েও যখন ক্রেতা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা, তখন ব্লক মার্কেটে কোম্পানিটির শেয়ারের হাতবদল হয়েছে চড়া দামে। ওই দিনই ব্লক মার্কেটে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ২ লাখ ১৪ হাজার শেয়ার ফ্লোর প্রাইসের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি দামে কিনে নেন এক ক্রেতা।

একই দিন একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে লুব-রেফ বাংলাদেশ, এডিএন টেলিকম, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বেশ কিছু শেয়ারের ক্ষেত্রে। কম দামে মূল বাজারে লাখ লাখ শেয়ার বিক্রি করতে চেয়ে যেখানে ক্রেতা মিলছে না, সেখানে বাজার দামের চেয়ে বেশি দামে ব্লক মার্কেটে অহরহ হাতবদল হচ্ছে কিছু কোম্পানির লাখ লাখ শেয়ার।

৯ সেপ্টেম্বর সোমবার। ডিএসইর মূল বাজারে ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ার ৮ টাকা ৩০ পয়সার ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হয়। বিক্রেতারা এ দামেই লাখ লাখ শেয়ার বেচতে আগ্রহী ছিলেন। অথচ এদিন ব্লক মার্কেটে ব্যাংকটির ২ কোটি শেয়ারের হাতবদল হয় ৯ টাকা ১০ পয়সায়।

অর্থাৎ বাজারমূল্যের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি দামে ব্লক মার্কেটে বিপুল শেয়ার বিক্রি হয়। একইভাবে বাজারে এদিন ৭৮৫ টাকায় কেনাবেচা হয় জেমিনি সি ফুডের শেয়ার, যা ব্লক মার্কেটে বিক্রি হয় ৮৫০ টাকায়। আর কন্টিনেন্টাল ইনস্যুরেন্সের শেয়ার মূল বাজারে ওই দিন কেনাবেচা হয়েছে ৩৭ টাকা ৬০ পয়সায়। ব্লক মার্কেটে কোম্পানিটির ১২ হাজার শেয়ারের হাতবদল হয় ৪২ টাকা ৭০ পয়সায়।

একই ঘটনা ঘটেছে অগ্রণী ইনস্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক ইনস্যুরেন্স, ক্রিস্টাল ইনস্যুরেন্স, ইস্টার্ন ইনস্যুরেন্স, ইস্টার্ন হাউজিং, এমারেল্ড অয়েল, ফাইন ফুডস, কর্ণফুলী ইনস্যুরেন্স, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ, নাভানা ফার্মা, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্স, পিপলস ইনস্যুরেন্স, প্রভাতী ইনস্যুরেন্স, রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, সোনালী পেপার ও ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্সের ক্ষেত্রে। এসব কোম্পানির শেয়ার বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে লেনদেন হয় ব্লক মার্কেটে। আবার বাজারমূল্যের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দামেও বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে এদিন ডিএসইর ব্লক মার্কেটে।

সাধারণত ব্লক মার্কেটে বাজারমূল্য বা তার চেয়ে কম দামে শেয়ার লেনদেন হয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বাজারে কম দামে কেনাবেচার সুযোগ থাকার পরও কিছু শেয়ার বেশি দামে কেনাবেচা হচ্ছে ব্লক মার্কেটে।

তাই ব্লক মার্কেটের এ ধরনের লেনদেন নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে একটি গোষ্ঠী ব্লক মার্কেটে শেয়ার কেনাবেচা করছে।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, যে শেয়ার বাজারে কম দামে পাওয়া যায়, সেই শেয়ার ব্লক মার্কেটে বেশি দামে কেনাবেচার কোনো যুক্তি নেই। এর পেছনে কারও না কারও স্বার্থ বা অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ ধরনের লেনদেন অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার।

কেন এ রকম ঘটনা ঘটছে, তা জরুরি ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা দরকার। এ ধরনের অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মূল দায়িত্ব।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি

ব্লক মার্কেট কী

শেয়ারবাজারে প্রচলিত বাজারের বাইরে বড় অঙ্কের শেয়ার লেনদেনের জন্যই ব্লক মার্কেট সুবিধা চালু করা হয়। মূল বাজারের চেয়ে ব্লক মার্কেটের তফাত হচ্ছে মূল বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা থাকে একে অপরের অচেনা। সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সবাই অংশ নেয় মূল বাজারের লেনদেনে।

আর ব্লক মার্কেটে লেনদেনের ক্ষেত্রে সাধারণত ক্রেতা-বিক্রেতা ও শেয়ারের দাম আগেই নির্ধারিত থাকে। শুধু শেয়ারের আনুষ্ঠানিক হাতবদল হয় এ মার্কেটে। আবার অনেক সময় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা নিজেদের এক বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব থেকে অন্য বিও হিসাবে শেয়ার স্থানান্তর করেন ব্লক মার্কেটের মাধ্যমে।

ব্লক মার্কেটে বেশি দামে কেনাবেচার কোনো যুক্তি নেই। এর পেছনে কারও না কারও স্বার্থ বা অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ ধরনের লেনদেন অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার।
শাকিল রিজভী, পরিচালক, ডিএসই

কেন বেশি দামে কেনাবেচা ব্লক মার্কেটে

একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী জানান, ব্লক মার্কেটে বেশি দামে শেয়ার কেনার পেছনে মূলত একাধিক উদ্দেশ্য থাকে। প্রথমত একটি গোষ্ঠী কৃত্রিমভাবে বাজারে লেনদেন বাড়াতে বেশি দামে নিজেদের মধ্যে এসব শেয়ারের হাতবদল করে। আবার আরেকটি গোষ্ঠী বেশি দামে শেয়ার লেনদেন করে নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে বাজারে। এ ক্ষেত্রে হচ্ছে একধরনের ‘আর্থিক লেনদেন’। অনেক ক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউসের একশ্রেণির কর্মকর্তা তাঁদের পরিচিত গ্রাহকের শেয়ার বেশি দামে কিনে প্রতিষ্ঠানের পোর্টফোলিও বা পত্রকোষে দিয়ে দেন। বিনিময়ে তাঁরা ওই বিক্রেতার কাছ থেকে নগদে কিছু আর্থিক সুবিধা নেন।

আবার অনেক সময় নেগেটিভ ইকুইটি বা ঋণাত্মক পোর্টফোলিওর বিপরীতেও এ ধরনের অনিয়ম করা হয়। শেয়ারবাজারে ঋণ করে যাঁরা বিনিয়োগ করেন, তাঁদের পোর্টফোলিওতে যখন নিজের বিনিয়োগ করা অর্থের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা ওই বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের আর খোঁজখবর রাখেন না।

এ সুযোগে এ ধরনের বিও হিসাবে গ্রাহকের অজান্তে বাড়তি দামে কেনা শেয়ার ঢুকিয়ে দিয়ে একইভাবে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তা। বিপরীতে ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীর ঋণ বা ক্ষতির বোঝা আরও বেড়ে যায়।

২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর এ ধরনের কয়েক লাখ বিও হিসাব রয়েছে। বছরের পর বছর এসব বিও হিসাব পড়ে থাকলেও এগুলো নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিক থেকে কোনো তদন্ত বা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি; বরং এসব বিও হিসাব হয়ে উঠেছে কারসাজির এক বড় হাতিয়ার।

আরও যেসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়

অনেক সময় তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড যাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে, তারা নিজেদের আয় বাড়াতে ব্লক মার্কেটে বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে শেয়ার লেনদেন করে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ‘এ’ একটি সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি। তার হাতে পাঁচটি মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। কোনো একটি মিউচুয়াল ফান্ডে ‘বি’ কোম্পানির এক কোটি শেয়ার রয়েছে। এখন মিউচুয়াল ফান্ডটি তার সম্পদ মূল্য বাড়িয়ে দেখাতে এই এক কোটি শেয়ার ব্লক মার্কেটে বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে অন্য একটি তহবিলে স্থানান্তর করে দিল। এতে যে তহবিল থেকে বিক্রি করা হয়েছে সেটি আয় বেশি হবে, তাতে তার সম্পদমূল্য বাড়বে। কারসাজিকারকেরা বেশি ঋণসুবিধা পেতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন।

ব্লকে যে সুযোগ করে দিল বিএসইসি

গত বছরের জুলাইয়ে শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর থেকে ব্লক মার্কেটকে ঘিরে অনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বেড়েছে। সেই সুবিধা করে দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিএসইসি গত নভেম্বরে বাজারমূল্যের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার কেনাবেচার সুযোগ দেয় ব্লক মার্কেটে। তাতে একশ্রেণির বিনিয়োগকারী ব্লক মার্কেট থেকে কম দামে শেয়ার কিনে তা মূল বাজারে বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। অর্থাৎ ব্লক মার্কেট থেকে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার কিনে মূল বাজারে তা ১০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি করছে।

ব্লক মার্কেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের সুযোগ কম। এ বাজারে লেনদেন করতে হলে ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকতে হয়। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে একশ্রেণির কারসাজিকারক এ সুবিধার অপব্যবহার করছেন। এর ফলে একটি ‘ব্লক মার্কেটকেন্দ্রিক বিশেষ চক্র’ গড়ে উঠেছে। এই চক্রকেও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ‘কারসাজি চক্র’ বলে অভিহিত করেন।

 জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারে অনেক কোম্পানির লেনদেন হচ্ছে না। তাই জরুরি প্রয়োজনে কোনো বিনিয়োগকারী চাইলে যাতে শেয়ার বিক্রির সুযোগ পান, সে জন্য ব্লক মার্কেটে বাজারমূল্যের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দামে বিক্রির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে বাজারে যে শেয়ার কম দামে পাওয়া যায়, সেই শেয়ার ব্লক মার্কেটে বেশি দামে কেনাবেচার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

কী বলছেন বিশ্লেষকেরা

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘বাজারে কম দামে যেখানে শেয়ার বিক্রি হচ্ছে, সেখানে বেশি দামে তা ব্লক মার্কেটে কেনাবেচার কোনো কারণই আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কেন এ রকম ঘটনা ঘটছে, তা জরুরি ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা দরকার। এ ধরনের অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মূল দায়িত্ব।’

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে আরও বলেন, ‘সাধারণত ব্লক মার্কেটে সমঝোতার ভিত্তিতে লেনদেন হয়। এখানেও বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে এ ধরনের লেনদেন হচ্ছে বলে ধারণা করি, যা বাজারের জন্য মোটেই সুখকর কিছু নয়।’