আরও দরপতন, লেনদেন আড়াই মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন

শেয়ারবাজারপ্রতীকী ছবি

দেশের শেয়ারবাজারে গতকাল মঙ্গলবার আরও বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। তাতে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৮৪ পয়েন্ট বা প্রায় দেড় শতাংশ কমেছে। সূচকের পাশাপাশি লেনদেনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। গত প্রায় আড়াই মাসের মধ্যে লেনদেন গতকাল সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।

ঢাকার বাজারের প্রধান সূচকটি গতকাল দিন শেষে নেমে এসেছে ৫ হাজার ৮১৪ পয়েন্টে। ২০২১ সালের ২৩ মের পর এটিই ডিএসইএক্স সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। সর্বশেষ ওই দিন ডিএসইএক্স সূচকটি ৫ হাজার ৭৮৮ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল।

প্রায় এক মাস ধরে শেয়ারবাজারে দরপতন চলছে। এর ধারাবাহিকতায় ১৩ মার্চ ডিএসইএক্স সূচকটি ৬ হাজার পয়েন্টের মনস্তাত্ত্বিক সীমার (সাইকোলজিক্যাল বেরিয়ার) নিচে নেমে আসে। এরপর বাজারে দরপতন আরও তীব্র হয়।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টানা দরপতন চলতে থাকায় বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে অনেক বিনিয়োগকারী এখন শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করছেন বেশি। ভালো শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় চলে এলেও এসব শেয়ারের ক্রেতা কম। ফলে দরপতন থামছে না।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দিনে এ বাজারের প্রধান সূচকটি ১৫৪ পয়েন্ট বা আড়াই শতাংশের মতো কমে গেছে। এর মধ্যে গতকাল এক দিনে কমেছে প্রায় দেড় শতাংশ। গতকাল বাজারে এতটাই দরপতন হয়েছে যে এক দিনে বাজার মূলধন প্রায় ৩৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা কমে গেছে। অর্থাৎ এ দিন লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বা ইউনিট সম্মিলিতভাবে ৩৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার দর হারিয়েছে। উল্লেখ্য, ডিএসইর বাজার মূলধন গতকাল ছিল ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বিনিয়োগকারীরা যখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, তখন কোনো যৌক্তিক কারণ সেখানে আর কাজ করে না। তবে বাজারের এ পতন দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটি গোষ্ঠী নানা গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের হয়তো বিভ্রান্ত করছে। কোনো গোষ্ঠী ইচ্ছেকৃতভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে কি না, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে পারে।

ঢাকার বাজারে গতকাল লেনদেন শুরু হয় পতন দিয়ে। বেলা যত বেড়েছে, পতনের তীব্রতা তত বেড়েছে। গতকালের এ পতনে নতুন মাত্রা যোগ করে রবি আজিয়াটার শেয়ার। এদিন কোম্পানিটির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যস্তর উঠে যাওয়ায় দিনের শুরুতে এটির সর্বোচ্চ দরপতন হয়। দিনের লেনদেনের শুরুতে রবির প্রতিটি শেয়ারের দাম ১০ শতাংশ বা ৩ টাকা কমে নেমে আসে ২৭ টাকায়। এ দরপতনের ফলে সূচকেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে অস্বাভাবিক দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। কারসাজি বা গুজব ছড়িয়ে কেউ বাজারে দরপতন ঘটাচ্ছে কি না, সেটি আমরা গভীরভাবে খতিয়ে দেখছি। এ জন্য বাজারে তদারকি জোরদার করা হয়েছে।’

বিনিয়োগকারীদের উচিত এখন ধৈর্য ধারণ করা। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বিনিয়োগকারীরা যাতে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করেন, সে জন্য আশ্বস্ত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি

শেয়ারবাজারে শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে গতকাল সূচকের পতনের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল বীকন ফার্মা, রবি আজিয়াটা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি), রেনেটা, বেক্সিমকো ফার্মা, ব্র্যাক ব্যাংক, ওরিয়ন ইনফিউশন, ডেলটা লাইফ ইনস্যুরেন্স, উত্তরা ব্যাংক ও ওরিয়ন ফার্মা। এ ১০ কোম্পানির দরপতনের কারণে গতকাল ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছে ৪০ পয়েন্টের বেশি। অর্থাৎ ঢাকার বাজারে গতকাল সূচকটি যতটা কমেছে, তার অর্ধেক কমেছে উল্লিখিত ১০ কোম্পানির দরপতনের কারণে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে এখন ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দরপতনের আতঙ্ক ভর করেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্বল্প পুঁজির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বড় বিনিয়োগকারীরা কোনো না কোনোভাবে তাঁদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারলেও ছোটদের পক্ষে সেটি কঠিন।

ঢাকার বাজারে গতকাল লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৮১ শতাংশের দরপতন হয়েছে। দাম বেড়েছে মাত্র ১০ শতাংশের। দিন শেষে এ বাজারে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪৬৫ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ২২ কোটি টাকা কম। শুধু তা–ই নয়, গত আড়াই মাসের মধ্যে গতকাল ঢাকার বাজারে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি ডিএসইতে সর্বনিম্ন ৪৪১ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল।

বাজারের এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের করণীয় বিষয়ে ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বিনিয়োগকারীদের উচিত এখন ধৈর্য ধারণ করা। কারও ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ থাকলে উদ্বিগ্ন না হয়ে অপেক্ষা করাই ভালো। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বিনিয়োগকারীরা যাতে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করেন, সে জন্য আশ্বস্ত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।