এমারেল্ড, লিগেসি, মিরাকেল কী বার্তা দিচ্ছে শেয়ারবাজারের

গত ছয় মাসে শেয়ারবাজারে যেসব কোম্পানি লেনদেন ও মূল্যবৃদ্ধিতে এগিয়ে আছে, সেগুলোর বেশির ভাগই মানহীন কোম্পানি। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা।

দেশের শেয়ারবাজার কেমন চলছে, জানতে চান? তাহলে একবার ভালোভাবে ওপরের ছকটি দেখে নিন। কয়টি কোম্পানিকে চেনেন? এসব কোম্পানির কোনো পণ্য বা সেবার সঙ্গে কি আপনি পরিচিত? আপনার উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি দেশের বেসরকারি খাতের কোম্পানি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে অনেক বেশি খোঁজখবর রাখেন। আর যদি কোম্পানিগুলো বা তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে আপনার খুব বেশি জানা না থাকে, তাহলে কয়েকটি তথ্য জেনে নিতে পারেন।

মাত্র ছয় মাসে ৪০০ শতাংশ বা চার গুণ মূল্য বৃদ্ধি হওয়া এমারেল্ড অয়েল বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির পর দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। সম্প্রতি কোম্পানিটির মালিকানায় বদল এসেছে। মিনোরি বাংলাদেশ নামে একটি কোম্পানি নতুন করে যুক্ত হয়েছে কোম্পানিটির মালিকানায়। তাতেই কোম্পানিটির শেয়ার গত ছয় মাসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমারেল্ড অয়েলের পর গত ছয় মাসে শেয়ারবাজারে মূল্যবৃদ্ধিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা লিগেসি ফুটওয়্যার গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশই দিতে পারেনি। ওই বছর শেষে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৮৬ পয়সা লোকসান করেছে। অর্থাৎ এটি একটি লোকসানি কোম্পানি।

আর মূল্যবৃদ্ধিতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের কারখানা বন্ধ দীর্ঘদিন ধরে। বন্ধ কারখানাটি ভাড়ায় অন্যের জন্য পণ্য তৈরি করা হয়। সর্বশেষ গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের যে আর্থিক প্রতিবেদন কোম্পানিটি প্রকাশ করেছে, তাতে এটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আবার এ কোম্পানির আর্থিক বিবরণীর নানা বিষয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমনকি কোম্পানিটির কারখানার জমির মালিকানা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করা হয়েছে নিরীক্ষকের পক্ষ থেকে। এমন একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ছয় মাসে আড়াই গুণ হয়ে গেছে।

এ ছাড়া মূল্যবৃদ্ধিতে চতুর্থ অবস্থানে থাকা মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজও একটি বন্ধ কোম্পানি। সেই কোম্পানির শেয়ারের দামও ছয় মাসে দ্বিগুণ হয়েছে।

আপনি যদি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হন, তাহলে ওপরের ছক ও যেসব তথ্য উল্লেখ করা হলো, তাতে শেয়ারবাজার নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার একটি ধারণা হয়েছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপনার বিনিয়োগের আগ্রহে ছেদ পড়েছে।

গত কয়েক মাসে শেয়ারবাজারে লেনদেন ও মূল্যবৃদ্ধিতে যেসব কোম্পানি শেয়ারবাজারকে প্রতিনিধিত্ব করছে, তাতে এ বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা রীতিমতো হতাশ। নতুন বিনিয়োগে আগ্রহীরা যেমন আগ্রহ হারাচ্ছেন, তেমনি বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরাও পুঁজি নিয়ে বাজার ছাড়ার সুযোগ খুঁজছেন।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে প্রতিনিধিত্ব করছে এখন বন্ধ ও লোকসানি কোম্পানি। অন্যদিকে ভালো মানের কোম্পানিগুলোর শেয়ার আটকে আছে সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইসে। এসব কোম্পানির তেমন কোনো লেনদেনও হচ্ছে না বাজারে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মানহীন কোম্পানির দাপট পুরো শেয়ারবাজারের চিত্রই বদলে দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, কারসাজির মাধ্যমেই এসব শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে। এ কারণে ভালো বিনিয়োগকারীরা বাজারবিমুখ হচ্ছেন। বাজারের সামগ্রিক চিত্রে নাখোশ সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাজার মধ্যস্থতাকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সবাই।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দিনের পর দিন কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটলেও এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সংস্থাটির নিশ্চুপ অবস্থান কারসাজিকারকদের আরও বেশি উৎসাহিত করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী বলেন, শেয়ারবাজারের দুর্ভাগ্য এখন এ বাজারের প্রতিনিধিত্ব করছে ফু-ওয়াং ফুড, এমারেল্ড অয়েল আর মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের মতো প্রতিষ্ঠান।

এমন এক সময়ে শেয়ারবাজারে দুর্বল মৌলভিত্তি ও বন্ধ কোম্পানির দাপুটে অবস্থান তৈরি হয়েছে, যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোড শো করছে। সর্বশেষ গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকা ও মরিশাসে রোড শো করেছে বিএসইসি। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজারের যে অবস্থা, তাতে দেশি বিনিয়োগকারীরাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ বা আশা করাটা ‘অবাস্তব’ এক উদ্যোগ।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, মাসের পর মাস শেয়ারবাজারে জাঙ্ক বা মানহীন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে, এটা খালি চোখেই বোঝা যায়। এর ফলে মুষ্টিমেয় কারসাজিকারক হয়তো লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু যাঁরা লোভে পড়ে এসব শেয়ার কিনবেন, তাঁরা বড় ধরনের লোকসানে পড়বেন। এ কারসাজি বন্ধের দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। কিন্তু সেটি না করে তারা ব্যস্ত, সূচক কীভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে। আর দিনের পর দিন কারসাজির ঘটনায় আস্থা হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে এ রকম একটি বাজারে নতুন করে কেউ বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না—এটাই স্বাভাবিক।