পুঁজিবাজারে ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় মুখে মুখেই কথা বলছে বেশি। সরকার কখনো কখনো নামকাওয়াস্তে চিঠি দিচ্ছে সরকারি কোম্পানিগুলোকে।
কখনো–বা আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠক করেও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিন্তু কার্যকর হচ্ছে না কিছুই। কারণ, কেউই সরকারের কথা শুনছে না।
ফলে বছরের পর বছর বৈঠক হচ্ছে এবং একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বারবার। শেয়ারবাজারে আসতে দেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন সময়সীমাও। কিন্তু যেসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসার কথা, তারা থাকছে একই জায়গায়। কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসছে না তাদের।
এমন বাস্তবতায় গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ পুঁজিবাজার উন্নয়নে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে আবার বৈঠক করেছে। পুঁজিবাজার উন্নয়নে অংশীজনদের নিয়ে অর্থমন্ত্রী সর্বশেষ বড় বৈঠক করেছিলেন কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বরাবরের মতো এটিও নিষ্ফলা হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠকে বিএসইসির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সরকারি কোম্পানিকে পাঠানোর তাগিদ নিয়েও আলোচনা হয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল রোববার বলেন, ‘খুব আশাবাদী ছিলাম প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে আসবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পর্ষদ নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয় বলে কাজটা হয়নি।’
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পর্ষদের কী সাধ্য আছে তা অমান্য করার, এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘তারা না-ই আসতে চাইতে পারে। তবে বিকল্প হিসেবে আমরা এবার আইন সংশোধন করে তাদের বাজারে আসতে বাধ্য করতে পারি।’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কোম্পানির শেয়ার ছাড়া নিয়ে প্রথম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালের মাঝামাঝিতে বিএনপি আমলের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে। ৬৬টি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান তখন চিহ্নিত করা হয়। এরপর ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে পাওয়ার গ্রিড, ডেসকো, তিতাস গ্যাসসহ পাঁচটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ আমলের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৬ থেকে ২৬টিতে নামিয়ে আনে। কোম্পানিগুলোকে ছয় মাসের মধ্যে শেয়ার ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। এরপর বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্লস। আর পুনরায় প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (রিপিট আইপিও) মাধ্যমে শেয়ার ছেড়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)।
যেসব কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার সিদ্ধান্ত আছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, বাখরাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি., গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি, জালালাবাদ গ্যাস সিস্টেম লি., বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লি., সোনারগাঁও হোটেল, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস লি., সিলেট গ্যাস ফিল্ড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লি., বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড লি. এবং রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লি.।
এ ছাড়া রয়েছে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ, চিটাগং ডকইয়ার্ড, কর্ণফুলী পেপার মিলস, বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লি., ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লি., বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, টেলিটক, বাংলাদেশ কেব্ল শিল্প লিমিটেড ও টেলিফোন শিল্প সংস্থা।
ব্যাংক খাতের মধ্যে রয়েছে সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও বিডিবিএল এবং ইতিমধ্যে তালিকাভুক্ত রূপালী ব্যাংকের আরও শেয়ার ছাড়া। জানা গেছে, টেলিটক, কর্ণফুলী পেপার মিল, বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর ও স্যানিটারিওয়্যার, ছাতক সিমেন্ট কারখানাসহ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার বিপক্ষে বিএসইসি।
বিএসইসি বাজারে আসার মতো কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সম্প্রতি আলাদা করে চিঠি পাঠিয়েছে। যেমন বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এমডি শংকর মজুমদারকে পাঠানো এক চিঠিতে বিএসইসি বলেছে, ‘আপনার প্রতিষ্ঠানের বর্তমান মানদণ্ডের ক্রমাগত উৎকর্ষ অর্জন এবং রূপকল্প ২০৪১–এর বাস্তবায়নে বৈশ্বিক বাজারে পদার্পণের জন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি অতীব জরুরি।’
বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা তাগিদ দিয়েই যাচ্ছি। এবার কিছু কোম্পানির ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী।’
বাখরাবাদ গ্যাসের এমডি শংকর মজুমদারকে গতকাল একাধিকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি বলে এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির বৈঠকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচটি ব্যাংকের শেয়ার ছাড়ার জন্য ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।
এর মধ্যে রূপালী ব্যাংকের প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ার বাজারে রয়েছে। নতুন করে এটির আরও ১০ শতাংশ শেয়ারবাজারে ছাড়তে চায় সরকার। এর বাইরে ধাপে ধাপে বাকি চারটি ব্যাংকেরও ২৫ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণারও কোনো বাস্তবায়ন নেই।
সরকারি কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম গত শনিবার এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, অর্থমন্ত্রী চাচ্ছেন সরকারি কোম্পানিগুলো বাজারে আনতে, কিন্তু কোম্পানিগুলোর পর্ষদ চায় না। এসব কোম্পানির পরিচালনায় গতিশীলতা আনতে পর্ষদগুলো ভেঙে দেওয়া উচিত।