আস্থা ও সুশাসন নেই, তাই পতন

এত ঘোষণা, এত আয়োজন, এত বৈঠক—অথচ কোনো কিছুই কাজে দিচ্ছে না। শেয়ারবাজারে দরপতন চলছেই। কমছে লেনদেনও। মাঝখানে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জের বিরোধ।

শেয়ারবাজারের জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে কিছু কর প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও দেওয়া হবে বলে কয়েক মাস ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। শিক্ষামূলক নানা কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে বিএসইসি।

আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পুঁজিবাজারের গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তব্য দিচ্ছেন, বৈঠক করছেন। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ-সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য স্বল্প সুদে টাকা ধার নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। কিন্তু সবই যেন নিষ্ফল। বাজার কোনো কিছুতেই মাথা তুলছে না।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী গতকাল রোববার বলেন, ‘সুশাসনের ঘাটতি ও আস্থার সংকট তো আছেই, বাজার নিয়ে একের পর এক ভুল পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করার সক্ষমতা বৃদ্ধির ঘোষণা দিল, তা কি ঠিক পদক্ষেপ? এ বাজারে দুই মাসের ব্যবধানে একটি শেয়ারের দাম বেড়ে যায় তিন গুণ, এটা কি স্বাভাবিকতা?’

সূত্রগুলো জানায়, বিএসইসির সঙ্গে ডিএসইর একধরনের বিরোধ চলছে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) নিয়েই বিরোধ। ডিএসই আইপিওর দায়িত্বে থাকতে চায়, কিন্তু বিএসইসি তা ছাড়তে নারাজ।

বিএসইসির কমিশনার হেলাল উদ্দিন নিজামী গত শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। বিএসইসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। গত পাঁচ থেকে ছয় বছরে স্টক এক্সচেঞ্জে যোগ্য নেতৃত্ব দেখা যায়নি। হতভাগা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ আইপিওর ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বলে। তারা কি ভুলে গেছে লিফটের মধ্যেও আইপিও শেয়ার বিলিবণ্টন হয়েছে এবং সেগুলো নিয়ে পরে কী হয়েছে?

>

শেয়ারবাজার নিয়ে সুপরিকল্পিত কোনো পদক্ষেপ নেই
প্রায় প্রতিদিন বাজারে দরপতন হচ্ছে
আর তা সাময়িকভাবে মোকাবিলার চেষ্টা চলছে

এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান এক অনুষ্ঠানে বলেন, গাছ যেমন ছায়া দেয়, কোম্পানির শেয়ার তেমনই বিনিয়োগকারীদের ছায়া দিয়ে রাখার কথা। কিন্তু সত্য যে এমন শেয়ারও এখন আসছে যে ছায়া তো দূরের কথা, পাতাও পাওয়া যাচ্ছে না।

কয়েক মাসের ধারাবাহিকতায় সপ্তাহের প্রথম দিনে গতকাল দরপতন ঘটেছে শেয়ারবাজারে। এদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২১ পয়েন্ট কমে হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৯১৭ পয়েন্ট। আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান সূচক সিএসপিআই ৫৬ পয়েন্ট কমে হয়েছে ১৪ হাজার ৯৬৬ পয়েন্ট।

ডিএসইতে এদিন ৩০৭ কোটি ২২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা আগের দিনের চেয়ে ২১ কোটি ৪২ লাখ টাকা কম। অন্যদিকে সিএসইতে গতকাল ১২ কোটি ৩৭ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা আগের দিনের চেয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা কম।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, এ বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ তিন থেকে সাড়ে তিন গুণ বেশি। আর বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার লোক আছে, কিন্তু বাজারে টাকা বিনিয়োগের লোক কম। তাই আইপিও একদম বন্ধ করে দিতে হবে।

পুঁজিবাজার নিয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষেঅর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, অর্থনীতির মৌলিক এলাকা পুঁজিবাজার। একে অবহেলা করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অনেকবার বক্তব্য দিয়েছেন। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ছাড়া সামনে এগোনো যাবে না।

কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজারের বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থার সংকট, সুশাসনের অভাব ও অতিরিক্ত সরবরাহ। এগুলো সমাধানের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেই সরকারের।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, খামাখা ৫ থেকে ১০ মিনিট করে বক্তব্য দিয়ে বাজারের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। দরকার হচ্ছে বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইডিআরএ—এসব সংস্থা বসে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করা। তারপর স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। কিন্তু সে পথে যাওয়া হচ্ছে না।

বাজারের এ দশা কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, বিএসইসি তার নিজের কাজ করছে, সরকার একে সমর্থনও দিচ্ছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই তাদের দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে।