ড্রোনের বাজার বড় হচ্ছে

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় গত মাসে দেশে প্রথমবারের মতো ‘ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন নীতিমালা, ২০২০’ জারি করেছে।

শূন্য থেকে ভিডিও বা ছবি তুলতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখন ড্রোনের ব্যবহার বাড়ছে
ছবি: প্রথম আলো

কীটনাশক ছিটানো থেকে জরিপকাজ পরিচালনা, চলচ্চিত্রের শুটিং থেকে গবেষণা, জরুরি সাহায্য পাঠানো থেকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা—হেন কোনো কাজ নেই, যে কাজে এখন মনুষ্যবিহীন আকাশযান অর্থাৎ ড্রোনের ব্যবহার নেই। ড্রোনের ব্যবহার যে বাড়ছে, সরকার তা বুঝতে পারছে। গুরুত্ব অনুধাবন করেই বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় গত মাসে ‘ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন নীতিমালা, ২০২০’ জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, ড্রোন এবং ড্রোনের যন্ত্রাংশ আমদানি তো করা যাবেই, এগুলো উৎপাদনের কারখানাও করা যাবে দেশে।

নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, বিশ্বে বর্তমানে কৃষিকাজ ও কৃষির উন্নয়ন, আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ, পরিবেশ ও ফসলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, মশার ওষুধ বা কীটনাশক স্প্রে ছিটানোর জন্য ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। জরুরি সাহায্য পাঠানো, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদি কাজেও রয়েছে ড্রোনের ব্যবহার। প্রযুক্তি সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশেও ব্যক্তিগত, সরকারি-বেসরকারি, সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন পর্যায়ে ড্রোনের ব্যবহার বাড়ছে। আবার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও দিন দিন বাড়ছে ড্রোনের ব্যবহার।

নীতিমালা কার্যকরের উদ্দেশ্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), শিল্প ও বাণিজ্যসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে নীতিমালা জারির ছয় মাসের মধ্যে নিজ নিজ অনুমোদন, প্রত্যয়ন ও অনাপত্তি দেওয়ার পদ্ধতি বের করার কথা বলা হয়েছে। তবে নীতিমালা বিশ্লেষণ করে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এতে এমন সব কঠিন শর্ত দেওয়া আছে, যাতে ড্রোন আমদানি এবং এর উৎপাদন কারখানা করা—দুটোই প্রায় অসম্ভব হবে।

বেবিচক ২০১৪ সাল থেকে দেশে ড্রোন ওড়ানোর অনুমতি দিয়ে আসছে, যদিও আমদানির যথাযথ কোনো নীতিমালা ছিল না। এটি আমদানিতে কর-ভ্যাট নেওয়া হয় ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশে ২ থেকে ৩ কেজি ওজনের ড্রোন আসে বিদেশ থেকে। এসব ড্রোনে ক্যামেরা থাকে, যেগুলো সাধারণত ফটোগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফাররা ব্যবহার করেন৷ বিনোদনের জন্যও ব্যবহার করছেন অনেকে।

নীতিমালায় ড্রোন উৎপাদন ও আমদানিতে নানা শর্ত দেওয়া রয়েছে। যেমন ড্রোন বা ড্রোনের যন্ত্রাংশ আমদানি করতে গেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রণীত আমদানি নীতি অনুসরণ করতে হবে। আর উৎপাদন করতে গেলে মানতে হবে শিল্প মন্ত্রণালয় প্রণীত শিল্পনীতি। পাঁচ কেজির বেশি ওজনের ড্রোন উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অনাপত্তিপত্র লাগবে। কিন্তু খেলনাজাতীয় ড্রোন উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ধরনের অনুমতি নিতে হবে না।

ড্রোনের বাজার বড় হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

আবার চার ধরনের ড্রোন আমদানির আগে (৫ কেজি ওজনের বেশি) এগুলোর বিবরণ দিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রেও লাগবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র।

যে নীতিমালা করা হয়েছে, তা অনুসরণ করে ড্রোন আমদানি করা বা কারখানা স্থাপন করা কঠিন হবে কি না জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান ও পর্যটনসচিব মো. মুহিবুল হক গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় এক বছর ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে অনেকবার বৈঠক করে নীতিমালাটি করা হয়েছে। কারও কিছু বলার থাকলে লিখিত আবেদন করতে পারেন। সংশোধনের জন্য তখন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।’

চার ধরনের ড্রোন, তিন ধরনের জোন

ব্যবহারের ভিত্তিতে ড্রোনকে ক, খ, গ ও ঘ—এই চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। ক শ্রেণির ড্রোন বিনোদনে; খ শ্রেণির ড্রোন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিদের মাধ্যমে শিক্ষা ও গবেষণার মতো অবাণিজ্যিক কাজে; গ শ্রেণির ড্রোন জরিপ, স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্র নির্মাণ, পণ্য পরিবহনের মতো বাণিজ্যিক ও পেশাদারির কাজে এবং ঘ শ্রেণির ড্রোন শুধু রাষ্ট্রীয় ও সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে।

এদিকে সবুজ, হলুদ ও লাল নামে তিনটি জোন করা হয়েছে। সবুজ জোন হচ্ছে বিমানবন্দর বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কেপিআই) তিন কিলোমিটারের বাইরের এলাকা, যেখানে ড্রোন চালাতে কোনো অনুমতি নিতে হবে না। হলুদ জোনের মধ্যে রয়েছে সংরক্ষিত, সামরিক, ঘনবসতি ও জনসমাগমপূর্ণ এলাকা, যেগুলোতে অনুমতি নিয়ে ড্রোন চালাতে হবে। আর লাল জোনের মধ্যে রয়েছে নিষিদ্ধ এলাকা, বিপজ্জনক এলাকা, বিমানবন্দর এবং বিশেষ কেপিআই; যেখানে বিশেষ অনুমতি নিয়ে চালাতে হবে।

রাতে অনুমতি লাগবে

বেবিচকের বিশেষ অনুমতি ছাড়া ক, খ ও গ শ্রেণির ড্রোন রাতে (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়) চালানো যাবে না। ক শ্রেণিতে ৫ কেজি ওজনের মধ্যে থাকা ড্রোন অথবা ১০০ ফুটের কম উচ্চতার উড্ডয়ন সক্ষম ড্রোন বিনোদন হিসেবে সবুজ জোনে অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করা যাবে।

খ ও গ শ্রেণির ড্রোন যেকোনো জোনে বেবিচকের নির্ধারিত নিয়মকানুন মেনে চালানো যাবে। ঘ শ্রেণি ছাড়া যেকোনো শ্রেণির ড্রোন হলুদ ও লাল জোনে উড্ডয়নের ক্ষেত্রেও বেবিচকের নিয়মকানুন মানতে হবে। বিশেষ অনুমতি ছাড়া ভিভিআইপির সভা-সমাবেশস্থলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে অনুষ্ঠানের তিন দিন আগে থেকে ঘ শ্রেণি ছাড়া সব ধরনের ড্রোন উড্ডয়ন নিষিদ্ধ।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, ড্রোন চালানোর কারণে জনসাধারণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের কোনো ক্ষতি হলে বা গোপনীয়তা ভঙ্গ হলে ড্রোনচালক ও চালকের নিয়োগকারী দায়ীথাকবেন। ক শ্রেণির ৫ কেজি ওজনের মধ্যে থাকা ড্রোনের বিনোদন ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে উড্ডয়নের জন্য ড্রোনচালকের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে এসএসসি বা সমমানের।

বৈশ্বিক ও দেশের চিত্র

বাংলাদেশে ড্রোন আসে চীন থেকে। তিনটি প্রতিষ্ঠান আমদানি করলেও প্রধান আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ড্রোন বাংলাদেশ। র‌্যাব, পুলিশসহ বাংলাদেশের সব ধরনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন ড্রোন ব্যবহার করে৷ তাদেরকে ড্রোন সরবরাহ করে আমদানিকারকেরা।

আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৩০ হাজারের মতো ড্রোন ব্যবহারকারী রয়েছে। কঠিন নীতিমালার কারণে ৬৮০টি স্কুলের জরিপকাজে ড্রোন ব্যবহার করা যাচ্ছে না। গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছয় মাস ঘুরে দুটি ড্রোন ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ড্রোন কারখানা হচ্ছে চীনের ডিজেআই। এতে ১৪ হাজার কর্মী রয়েছে এবং বার্ষিক আয় ২৮৩ কোটি ডলার।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্য ও প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ড্রোনের বৈশ্বিক বাজার ছিল
৫৮০ কোটি ডলার, যা চলতি ২০২০ শেষে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। আর ২০২৫ সাল নাগাদ বৈশ্বিক বাজার হবে ১৩ হাজার কোটি ডলারের কাছাকাছি।

ড্রোন বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী কামরান হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী কারখানা করা তো যাবেই না, আমদানি করাও কঠিন হবে। আপাতত সমাধান হিসেবে সরকারের উচিত হবে ৪০ দিনের পরিবর্তে ১৫ দিনে অনুমোদন দেওয়া, প্রতিবার আলাদা অনুমতির পরিবর্তে এককালীন তিন মাস বা ছয় মাসের জন্য অনুমতি প্রদান এবং পর্যটনপ্রধান অঞ্চলকে সবুজ জোন হিসেবে ঘোষণা করে অনুমতি ছাড়া ড্রোন চালাতে দেওয়া।’