প্রতিবেশীর চেয়ে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কর বেশি

  • এক লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচায় এআইটি নেওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা, ডিবিএর দাবি ১৫ টাকা।

  • লভ্যাংশ আয়ের ওপর ২০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। ‍এটি ছয় দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।

প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে করের হার বেশি। এখানে সরকার দৈনিক লেনদেনের ওপর অগ্রিম আয়কর (এআইটি) যেমন বেশি নিচ্ছে, তেমনি লভ্যাংশ আয়ের ওপরও অধিক হারে কর আদায় করছে। আর করপোরেট করহারও সবার চেয়ে বেশি। এ ধরনের করনীতি মোটেও শেয়ারবাজারবান্ধব নয় বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) ১৮ জানুয়ারি এমন অভিযোগ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে প্রতিকার চেয়েছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের পাঁচটি স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে ডিএসইর ওপর আরোপিত করকাঠামোর তুলনা করে চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি।

ডিবিএর চিঠিতে বলা হয়েছে, আদর্শ ও যুক্তিসংগত করনীতির ফলে পাঁচ দেশেরই শেয়ারবাজার আজ সুবিশাল। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের চেয়ে তারা বহুগুণ সক্রিয় ও গতিশীল অবস্থানে রয়েছে। যুক্তিসংগত করনীতিই সেসব দেশের উদ্যোক্তা, ব্রোকার, বিনিয়োগকারীসহ সব অংশীজনের শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণে আগ্রহী করে তুলেছে।

যুক্তিসংগত করনীতির দাবিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের শরণাপন্ন হয়েছে ডিবিএ।

সংগঠনটি আরও বলেছে, সিকিউরিটিজ লেনদেন ও ব্রোকারদের আয়ের ওপর ন্যায্য করারোপে গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই ওই পাঁচ দেশের শেয়ারবাজার এত উন্নত। সহজ করনীতির ফলে বাজারে সুযোগ-সুবিধা তৈরি হয়, বাজার বৃদ্ধি পায় এবং লেনদেন বাড়ে। আর লেনদেন বাড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়ে। পাঁচটি দেশই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ডিবিএ সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর স্টক এক্সচেঞ্জের তুলনায় আমরা অনেক দিক থেকেই পিছিয়ে আছি এবং প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছি। আমরা চাই, একটা শেয়ারবাজারবান্ধব করনীতি। এ জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভূমিকা চাই।’

সমন্বয় হচ্ছে না এআইটি

সংগঠনটি বলেছে,দৈনিক সিকিউরিটিজ লেনদেনের ওপর অর্থাৎ কেনা ও বেচা উভয় ক্ষেত্রেই বর্তমানে সরকার এআইটি নিচ্ছে দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ হারে। এতে প্রতি এক লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনে এআইটি নেওয়া হয় ৫০ টাকা করে। অথচ এই এআইটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকরণ নয়। অর্থাৎ বার্ষিক মূল্যায়নের পর কম-বেশি হলেও এই এআইটি পরের বছরগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা হয় না। পুরো বিষয়টিই সুষ্ঠু এআইটি নীতির পরিপন্থী।

ডিবিএ জানায়, ভারতে ইক্যুইটি ও অন্যান্য সিকিউরিটিজ কেনার ওপর এআইটি দিতে হয় না। শুধু নিট বিক্রির ওপর দশমিক শূন্য ২৫ শতাংশ হারে দিতে হয়। সিকিউরিটিজের মোট বিক্রয়মূল্য থেকে ক্রয়মূল্য বাদ দিয়ে বাকি বিক্রয়মূল্যের ওপর এআইটি প্রযোজ্য হয় ভারতে। এমনকি মিউচুয়াল ফান্ড কেনার ওপরও ভারতে কোনো এআইটি নেই। তবে মিউচুয়াল ফান্ড বিক্রির ওপর এআইটি দিতে হয় দশমিক শূন্য শূন্য ১ শতাংশ হারে অর্থাৎ এক লাখ ভারতীয় রুপির মিউচুয়াল ফান্ড বিক্রিতে এআইটি মাত্র ১ রুপি।

আরও বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া স্টক এক্সচেঞ্জ (এমএসই), থাইল্যান্ড স্টক এক্সচেঞ্জ (টিএসই), সিঙ্গাপুর স্টক এক্সচেঞ্জ (এসএসই) এবং কলম্বো স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সিকিউরিটিজ লেনদেনের ওপর কোনো এআইটি নেওয়াই হয় না।

লভ্যাংশ আয়ে বেশি কর

ডিবিএ বলেছে, লভ্যাংশ আয়ের ওপর ২০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয় ডিএসইতে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে লভ্যাংশ আয়ের ওপর কোনো করই নেওয়া হয় না। ভারতে সিকিউরিটিজের ক্ষেত্রে লভ্যাংশ আয়ের ওপর কর ১৫ শতাংশ আর মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় এই কর ১৪ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ১০ শতাংশ (চূড়ান্ত)।

ব্রোকারদের সংগঠনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানায়, মূলধনি আয়ের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হয় ডিএসইতে। ভারত আর শ্রীলঙ্কায় অবশ্য এই হার একই। তবে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় মূলধনি আয়ের ওপর কর দিতে হয় না।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিবিএর দাবি আমাদের কাছেও এসেছে। আমরা এটা যাচাই ও বিশ্লেষণ করব, তারপর এনবিআরকে জানাব।’

সর্বোচ্চ করপোরেট কর

বাংলাদেশে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করপোরেট কর ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা আলোচ্য দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্য দেশগুলোর মধ্যে এই হার শ্রীলঙ্কায় ২৮, মালয়েশিয়ায় ২৪, ভারতে ২২ ও থাইল্যান্ডে ২০ শতাংশ। আর সিঙ্গাপুরে স্টক ব্রোকার কোম্পানির নিট আয়ের ওপর ১৭ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়।

সংগঠনটি বিভিন্ন করের হার শেয়ারবাজারবান্ধব করার দাবি জানিয়ে এ ব্যাপারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামকে ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেছে।

ডিবিএ বিদ্যমান এআইটি দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক শূন্য ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া ক্রয়মূল্য বাদ দিয়ে শুধু বিক্রয়মূল্যের ওপর তা আরোপের অনুরোধ করেছে। বাড়তি এআইটি পরের বছরের সঙ্গে যাতে সমন্বয় করা যায়, সেই সুযোগও চেয়েছে সংগঠনটি।

এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, করের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় তারা বিষয়টি এনবিআরে পাঠাবে। সরাসরি মন্ত্রণালয়ে না এসে ডিবিএ যাতে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মাধ্যমে দাবি জানায়, সেই পরামর্শও দিয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা।

ডিবিএর দাবির বিষয়ে এনবিআরের সদস্য (করনীতি) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি এখনো আমাদের কাছে আসেনি।’ তবে দেশে শেয়ারবাজারবান্ধব করনীতিই আছে বলে মনে করেন তিনি।