শিম কপি বেগুন ২–৩ টাকা কেজি

যশোরের বারীনগর সবজি মোকামে দাম একেবারে পড়ে গেছে। এতে কৃষকেরা হতাশ। তাঁরা সবজি সংরক্ষণে হিমাগার স্থাপনের দাবি জানান।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

যশোর সদর উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের কৃষক আলাউদ্দিন ৪০ কেজি শিম নিয়ে মোকামে গেলেন। ২ টাকা কেজি দরে সেই শিম বিক্রি করে ৮০ টাকা পেলেন। অথচ খেত থেকে শিম তোলা আর পরিবহনের জন্যই তিনি ১৪০ টাকা খরচ করলেন।

আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমি তিন বিঘাতে শিম চাষ করেছি। ইতিমধ্যে ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ৬০ হাজার টাকার মতো শিম বিক্রি করেছি। এখনো ৪০ হাজার টাকা ঘাটতি আছে। এখনো অন্তত তিন মাস খেতে শিম পাওয়া যাবে। ফলনও খুব ভালো হচ্ছে। কিন্তু দাম না পেলে শিম খেতে রেখে লাভ কী? খেত ভেঙে দিয়ে বোরো ধান চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

গতকাল বৃহস্পতিবার যশোর অঞ্চলের সবজির বৃহত্তম পাইকারি মোকাম বারীনগরে এভাবে আরও অনেক কৃষক আলাউদ্দিনের মতো আশানুরূপ দাম না পেয়ে হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তাঁরা এলাকায় বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপনের দাবি জানান, যাতে দাম কম হলে সবজি সংরক্ষণ করা যায়।

সরেজমিনে গতকাল বারীনগর সবজি মোকামে দেখা গেছে, প্রতি কেজি শিম ২ থেকে ৩ টাকা, বেগুন ৩ থেকে ৪ টাকা, ফুলকপি ২ টাকা, বাঁধাকপি ২ থেকে ৩ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৮ থেকে ১০ টাকা, নতুন পেঁয়াজ ২৫ টাকা ও পেঁয়াজের কলি ২ টাকা দরে কেনাবেচা হয়েছে। এদিন ব্যাপারীরা মোকাম থেকে সবজি কিনে ট্রাকে করে সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়েছেন।

কৃষক হতাশ হয়ে পড়লে উৎপাদনের ধারা ধরে রাখা কঠিন হবে। আমরা বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করছি।
বাদল চন্দ্র বিশ্বাস, উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যশোর

ছোট হৈবতপুর গ্রামের ইজাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর ৩ বিঘা জমিতে শিম আর ১৩ কাঠায় বেগুন চাষ করেছি। ৯০ কেজির দুই বস্তা শিম নিয়ে হাটে গেলে প্রতি কেজির দাম ওঠে আড়াই টাকা। অথচ খেত থেকে ওই শিম তুলে বস্তায় ভরে হাটে নিতে তার চেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়েছে। তাই দুঃখে শিম বিক্রি করি নাই। যে শ্রমিকেরা ওই শিম খেত থেকে তুলে দিয়েছেন তাঁদের দিয়ে খালি হাতে বাড়িতে ফিরে গেলাম।’ তিনি জানান, সার ও কীটনাশকের দোকানে ৬৩ হাজার টাকা দেনা রয়েছে। সবজিখেত ভেঙে দিয়ে নতুন করে বোরো ধান চাষের টাকাও তাঁর হাতে নেই।

কৃষকেরা জানান, ১৫ দিন ধরে সবজির মোকামে এ অবস্থা চলছে। বেগুনের দাম কমে এরই মধ্যে দেড় টাকা কেজিতে নেমে গেছে। এখন আর খেতে সবজি রাখা যাচ্ছে না, আবার বাজারে নিলেও দাম কম।

দুঃখে শিম বিক্রি করি নাই। যে শ্রমিকেরা ওই শিম খেত থেকে তুলে দিয়েছেন তাঁদের দিয়ে খালি হাতে বাড়িতে ফিরে গেলাম।
ইজাজুল ইসলাম, সবজিচাষি, ছোট হৈবতপুর, যশোর সদর

জানতে চাইলে হাটের ইজারাদার ফরিদুর ইসলাম বলেন, ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে কৃষকেরা সবজির ভালো দাম পান। এরপর দেড় থেকে দুই মাস সবজির দাম একেবারেই থাকে না। খেত থেকে সবজি তুলে হাটে আনার খরচও তাঁদের ওঠে না। যে কারণে কৃষকেরা গরু–ছাগল দিয়ে খেতের সবজি খাইয়ে দিচ্ছেন। মাসখানেক আগেও এই হাট থেকে সপ্তাহে দুই দিন অন্তত ৫০ ট্রাক করে সবজি দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হতো। কিন্তু এখন ৫ থেকে ৬ ট্রাক সবজি যাচ্ছে।

ফরিদুর বলেন, ‘সবজি উৎপাদনের এই অঞ্চলে বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপনের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। ভালো মানের হিমাগার স্থাপিত হলে কৃষকেরা আলুর মতো সবজিও সংরক্ষণ করতে পারত। এতে পরে তারা ন্যায্যমূল্য পেত। ফলে কৃষকেরা লাভবান হতো। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও রপ্তানির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাঁধাকপি, পটোল, পেঁপে ও বরবটি রপ্তানি শুরু হয়েছে। শিম, ফুলকপি, বেগুন, টমেটো এসব সবজি রপ্তানির বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপনের বিষয়ে প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।

বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘এ কথা সত্য, খেত থেকে ফসল তুলে বাজারে নেওয়ার খরচই এখন উঠছে না। এতে কৃষকেরা অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ছেন। এখন বাজার সৃষ্টি ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সরকারকে বেশি দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ, কৃষক হতাশ হয়ে পড়লে উৎপাদনের ধারা ধরে রাখা কঠিন হবে। আমরা বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করছি।’

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলায় এ বছর ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে।