শেয়ারবাজারের তিন কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে দিল বিএসইসি

শেয়ারবাজারের তিন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কোম্পানি তিনটি হলো চট্টগ্রামভিত্তিক ফ্যামিলিটেক্স ও সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল এবং বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা ইউনাইটেড এয়ার।

আজ রোববার বিএসইসি এ তিন কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠনের আদেশ জারি করেছে। এ তিন কোম্পানিতে মোট ২০ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল ও ইউনাইটেড এয়ারে ৭ জন করে ১৪ জন এবং ফ্যামিলিটেক্সে ৬ জন। তবে নবনিযুক্ত পরিচালকদের বেশির ভাগের বিস্তারিত পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। বিএসইসির আদেশেও তাঁদের পরিচয়ের বিস্তারিত উল্লেখ ছিল না।

নতুন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের পাশাপাশি বর্তমান পরিচালকদের কোম্পানিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সব শেয়ারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখার বা ব্লক করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি। এর আগে বিএসইসি বস্ত্র খাতের কোম্পানি রিংসাইন টেক্সটাইল ও আলহাজ টেক্সটাইলের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছিল। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মোট পাঁচটি কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বিএসইসি। আরও কয়েকটি কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

চট্টগ্রামভিত্তিক ফ্যামিলিটেক্স ও সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল এবং বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা ইউনাইটেড এয়ারের পর্ষদ পুনর্গঠন করে আজ রোববার আদেশ জারি করেছে বিএসইসি। এ তিন কোম্পানিতে মোট ২০ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোম্পানিগুলো কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে খারাপ হওয়ায় এবং বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এ ছাড়া বিএসইসির অনুমোদন ছাড়া কোম্পানির সব ধরনের সম্পদের (স্থায়ী আমানতসহ) বিক্রি, বন্ধক, হস্তান্তর বা বিনষ্ট করা যাবে না বলেও আদেশে বলা হয়েছে।

কোম্পানি তিনটির মধ্যে ফ্যামিলিটেক্স ও সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল বর্তমানে দুর্বল মানের কোম্পানি হিসেবে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত। আর ইউনাইটেড এয়ারকে মূল বাজার থেকে ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) বাজারে স্থানান্তর করা হয়েছে।

ফ্যামিলিটেক্স

বিএসইসির নির্দেশে পুনর্গঠিত পর্ষদের মধ্যে বন্ধ ফ্যামিলিটেক্সকে সচল করার দায়িত্বভার পড়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলামের ওপর। তিনি হবেন কোম্পানিটির নতুন চেয়ারম্যান। তিনি ছাড়া পুনর্গঠিত পর্ষদে নতুন পরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন সমীর কুমার শীল, গাজী মোহাম্মদ হাসান জামিল, জামিল শরীফ, শরীফ আহসান ও ফরজ আলী।

বস্ত্র খাতের চট্টগ্রামভিত্তিক এ কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। শেয়ারধারীদেরও কোনো ধরনের লভ্যাংশ দিচ্ছে না। মূলত কোম্পানিটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ ও চেয়ারম্যান রুখসানা কোম্পানিটি থেকে তাঁদের বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার পর থেকে এটির অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। কোম্পানিটির মালিকানা হাতবদলের পর এটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন মেহরাজ ই মোস্তফা। আর পরিচালক তাঁর স্ত্রী তাবাসসুম করিম।

একসময় বিএসএ গ্রুপ নামে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক এক পোশাক কারখানার মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসেবে কাজ করতেন মেহরাজ ই মোস্তফা। চাকরিজীবী থেকে হয়ে যান উদ্যোক্তা। অভিযোগ আছে, বিপুল আর্থিক অনিয়মের কারণেই চাকরিচ্যুত করা হয় মেহরাজ ই মোস্তফাকে। বিএসএ গ্রুপের অনিয়মের অর্থে মালিকানা কেনেন ফ্যামিলিটেক্সের।

মূলত শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলে সেই টাকা লুটপাট করে অন্য ব্যবসায় খাটিয়ে লাভবান হয়েছেন ফ্যামিলিটেক্সের উদ্যোক্তারা। যদিও ২০১৮ সালের পর থেকে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না।

২০১৩ সালে কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ৩৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। ফ্যামিলিটেক্সের বর্তমান উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি বন্ধ রাখলেও তাঁদের মালিকানায় অন্য কোম্পানিগুলো সচল রয়েছে। এমনকি নতুন কোম্পানিও খুলছেন।

জানা গেছে, মূলত শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলে সেই টাকা লুটপাট করে অন্য ব্যবসায় খাটিয়ে লাভবান হয়েছেন ফ্যামিলিটেক্সের উদ্যোক্তারা। যদিও ২০১৮ সালের পর থেকে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না।

সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল

কোম্পানিটিতে নতুন করে সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে বিএসইসি। চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় অবস্থিত কোম্পানিটির কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বন্ধ এ কোম্পানিকে কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বর্তমানে অবসরপূর্ব ছুটিতে থাকা সরকারের অতিরিক্ত সচিব নারায়ণ চন্দ্র দেবনাথ। তিনি হবেন কোম্পানির নতুন চেয়ারম্যান।

নারায়ণ চন্দ্র দেবনাথ ছাড়াও কোম্পানিটিতে নিযুক্ত নতুন স্বতন্ত্র পরিচালকেরা হলেন মোহাম্মদ শরিয়ত উল্লাহ, এ বি এম শহীদুল ইসলাম, রেজওয়ানুল হক খান, এ বি এম আশরাফুজ্জামান, তৌফিক ও শরীফ আহসান।

২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুখসানা মোর্শেদ, পরিচালক শারমিন আকতার ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিচালক বাংলাদেশ শু ইন্ডাস্ট্রিজকে গত জুলাইয়ে ১৪ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল বিএসইসি। আইন লঙ্ঘন করে কোনো ঘোষণা ছাড়া তাঁদের হাতে থাকা বিপুল শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে ১২ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করায় এ জরিমানা করা হয়।

সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল আইপিওতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাজারে এসেছিল। ওই সময় তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও হয়েছিল। কিন্তু সেসবে ‘রা’ করেনি বিএসইসির তৎকালীন কমিশন। যে কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন এম খায়রুল হোসেন, যাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি মানহীন কোম্পানিকে বাজারে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

ইউনাইটেড এয়ার

আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে থাকা এ কোম্পানিকে কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন সাত পরিচালককে। বিএসইসির নিযুক্ত সাত স্বতন্ত্র পরিচালকের মধ্য থেকে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে দ্য মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলমকে। এ ছাড়া অন্য ছয় পরিচালক হলেন সাদিকুল ইসলাম, মাকসুদুর রহমান সরকার, এ টি এম নজরুল ইসলাম, বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, মোহাম্মদ ইউনুস ও মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ইউনাইটেড এয়ারের শেয়ারের সিংহভাগেরই মালিকানা এখন ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠানের হাতে। কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে আছে মাত্র আড়াই শতাংশ শেয়ার। অথচ আইন অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে সম্মিলিতভাবে সব সময় ওই কোম্পানির ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। আর পরিচালকদের হাতে এককভাবে সব সময় ২ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

কার্যক্রমে না থাকা এ কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাসভীরুল আহমেদ চৌধুরীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ইতিপূর্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির বর্তমান দেনার পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা।