হোম অফিসের সুফলও মুনাফায়

শেয়ারবাজারের চাঙাভাব, করোনাকালের হোম অফিস আর উদ্বৃত্ত তারল্য সরকারের বন্ডে বিনিয়োগ—এই তিনে মিলে করোনার বছরে ভালো ব্যবসা করেছে আর্থিক খাতের তিন প্রতিষ্ঠান। করোনার কারণে আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ভালো হবে না—এমন আশঙ্কা ছিল বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যাংকবহির্ভূত তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বিনিয়োগকারীদের সেই ধারণা পাল্টে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠান তিনটি হচ্ছে আইডিএলসি ফিন্যান্স, আইপিডিসি ফিন্যান্স ও বিডি ফিন্যান্স।

করোনার বছরে তিন প্রতিষ্ঠানের আয় ও মুনাফা বেড়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি। গতকাল কোম্পানি তিনটি গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়া ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে শেয়ারধারীদের জন্য বছর শেষে মুনাফাও ঘোষণা করেছে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ওয়েবসাইটে গতকাল আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, গত বছর শেষে তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরই শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস বেড়েছে সর্বনিম্ন সাড়ে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ পর্যন্ত। যদিও বাংলাদেশের বাস্তবতায় আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তা সত্ত্বেও কোম্পানিগুলো নিরীক্ষা শেষে যে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেটির তথ্যকে মেনে নিতে হয়।

আইডিএলসি, আইপিডিসি ও বিডি ফিন্যান্স—এ তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইডিএলসি ও বিডি ফিন্যান্সের মুনাফা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে শেয়ারবাজারের চাঙাভাব। গত বছরের শেষ ছয় মাসে দেশের শেয়ারবাজারে ছিল বেশ চাঙাভাব। এ কারণে যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ যত বেশি ছিল, তাদের মুনাফাও তত বেশি হয়েছে। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ জুন থেকে ৩০ ডিসেম্বর—এ ছয় মাসে ঢাকার বাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ১ হাজার ৪১৫ পয়েন্ট বা প্রায় সাড়ে ৩৫ শতাংশ। এ সময়কালে কোনো কোনো শেয়ারের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। একদিকে শেয়ারের দাম বাড়ায় সেখান থেকে মূলধনি মুনাফা যুক্ত হয়েছে আয়ে। অন্যদিকে শেয়ারবাজার চাঙা থাকায় বাজারে বিনিয়োগ থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ারের লোকসানের বিপরীতে প্রভিশনিং বা অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়নি।

নিয়ম অনুযায়ী, সব ধরনের খরচ, কর ও প্রভিশনিং বাদ দেওয়ার পর যে মুনাফা থাকে, সেটিই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মুনাফা। ওই মুনাফাকে ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে ইপিএস হিসাব করা হয়। তাই ইপিএসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ভালো-মন্দ বোঝা যায়।

করোনার মধ্যে ভালো ব্যবসা করা তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেয়ারবাজারের চাঙাভাবের পাশাপাশি করোনাকালের হোম অফিসের সুফলও প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ে যুক্ত হয়েছে। হোম অফিসের কারণে বিদ্যুৎ বিল থেকে শুরু করে ভবন ভাড়া, গাড়ির খরচসহ নিয়মিত অনেক ধরনের খরচই কমে গেছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনগত খরচ অনেক কমে গেছে। এতেও প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বেড়েছে।

জানতে চাইলে আইপিডিসি ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মমিনুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে গত বছর আমাদের ৯ কোটি টাকার বেশি পরিচালন খরচ কমেছে। ভাড়া জায়গায় যেখানে আমাদের কার্যক্রম ছিল, সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া কমানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে যাতে মুনাফার এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারি, সে জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা প্রভিশনিং করা হয়েছে। তা না হলে মুনাফা আরও বাড়ত।’

করোনার কারণে গত বছরজুড়েই ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দাভাব। এ কারণে ঋণের চাহিদাও অনেক কমে যায়। তার বিপরীতে মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। ঋণ কমে আমানত বেড়ে যাওয়ার ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে অলস অর্থ বেড়ে যায়। সেই অর্থের একটি বড় অংশ মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ করে। ওই সময় ট্রেজারি বন্ডের সুদহারও অনেক বেশি ছিল। পরে সেই বন্ড বিক্রি করে দিয়ে সেখান থেকে ভালো মুনাফা করে প্রতিষ্ঠানগুলো।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফিন্যান্সের মুনাফার একটি বড় অংশ এসেছে বন্ডের মুনাফা থেকে। জানতে চাইলে আইডিএলসির এমডি আরিফ খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার শুরুতে আমাদের হাতে বেশ ভালো পরিমাণ তারল্য ছিল। এর মধ্যে সাধারণ ছুটি শুরু হলে ঋণের চাহিদাও অনেক কমে যায়। করোনাকালে উদ্বৃত্ত তারল্যের বড় একটি অংশ ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছিলাম। সেখান
থেকে গত বছর ৮০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছি। এ ছাড়া শেয়ারবাজার থেকেও আমাদের ভালো মুনাফা হয়েছে।’

বিডি ফিন্যান্সের মুনাফার বড় অংশই এসেছে শেয়ারবাজার থেকে। প্রতিষ্ঠানটির ইপিএসের ৪৫ পয়সা এসেছে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম থেকে। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির এমডি মোহাম্মদ কায়সার হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল ব্যবসা থেকে গত বছর আমাদের আয় বেড়েছে ৫ পয়সার মতো। তবে পরিচালন খরচ কমে যাওয়ায় ও শেয়ারবাজার থেকে ভালো আয় হওয়ায় বছর শেষে মুনাফা অনেক বেড়েছে।’