মজুত ভালো, তবে কমছে

রিজার্ভ প্রতিনিয়ত কমছে। তবে বাড়ছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। ফলে বড় দুশ্চিন্তায় নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আমদানি খরচ বাড়ায় রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে ডলারের চাহিদা মিটছে না। এতে ডলারের সংকট তৈরি হয়ে দাম বেড়েছে প্রায় ২০ টাকা। আমদানিতে ডলারের দাম দিতে হচ্ছে প্রায় ১০৫ টাকা। ডলার–সংকট মেটাতে ৭ মাসে রিজার্ভ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে হয়েছে ৩ হাজার ৬৪০ কোটি বা ৩৬ বিলিয়ন ডলার।

তবে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের পুরোটাই ব্যবহারযোগ্য নয়। কারণ, বিভিন্ন খাতে রিজার্ভ থেকে দেওয়া আছে ৮ বিলিয়ন ডলার, যা চাইলেই সহজে ফেরত পাওয়া যাবে না। সংকট বাড়লে পুরো রিজার্ভও ব্যবহার করা যাবে না। এ জন্য দেশে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ৯০০ কোটি বা ২৯ বিলিয়ন ডলার।

রিজার্ভ যেভাবে কমছে, এটা উদ্বেগজনক। প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়লেই রিজার্ভ বাড়বে। তবে ইউরোপে মন্দার কারণে রপ্তানিতে কী অবস্থা হয়, তা নিয়ে শঙ্কা আছে।
সেলিম রায়হান , নির্বাহী পরিচালক, সানেম

দেশে গত জুলাইয়ে আমদানিতে খরচ হয়েছে ৬৩৩ কোটি ডলার। আরও রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ পরিশোধ, প্রযুক্তি সেবা গ্রহণের মাশুল, শিক্ষা ও চিকিৎসা খরচ, বিমানভাড়াসহ নানা খাতের খরচ, যার পুরোটাই দিতে হয় ডলারে। ফলে যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ চার মাসের আমদানি দায় মেটানো যাবে।

অবশ্য দেশে ডলারের সংকট হলেও রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে। আবার বিদেশি ঋণ ও অনুদানও আসছে। ফলে রিজার্ভ নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানি চাপ কমাতে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার ধারণ ও ব্যবস্থাপনার এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের। বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার দায় অর্থাৎ আমদানি দায় পরিশোধের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, সাধারণত কোনো দেশের তিন মাসের বৈদেশিক মুদ্রার দায় মেটানোর মতো মজুত থাকতে হয়।

গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, রিজার্ভ যেভাবে কমছে, এটা উদ্বেগজনক। প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়লেই রিজার্ভ বাড়বে। তবে ইউরোপে মন্দার কারণে রপ্তানিতে কী অবস্থা হয়, তা নিয়ে শঙ্কা আছে।

সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাবও পড়েছে। এতে প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকারকে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে।

ডলার–সংকট

ডলার–সংকটই রিজার্ভ কমাচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর বেড়ে যায় জ্বালানি তেলের দাম। এর সঙ্গে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দামও বেড়ে যায়। ফলে গত এপ্রিলে দেশে যে পরিমাণ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হয়, আমদানি খরচ হয় তার চেয়ে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বেশি। এতেই ডলারের সংকট শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম আটকে রেখে সংকটকে আরও উসকে দেয়; পাশাপাশি সরকার জ্বালানি তেল ও খাদ্য আমদানি দায় মেটানোর জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে।

এমন পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন করে ধীরে ধীরে ডলারের দাম বাড়ানো শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি কমাতে কিছু পণ্যের ওপর ঋণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছু পণ্য আমদানিতে শতভাগ মার্জিন দেওয়া হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও কিছু পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। ফলে ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। তবে ডলারের সংকট এখনো কাটেনি।

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী প্রথম আলোকে বলেন,‘করোনায় রিজার্ভ যা বেড়েছিল, তা এখন খরচ হচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তিন মাসের আমদানি খরচের রিজার্ভ থাকলেই চলে। তবে এখন ডলার খরচ হবে এমন অবকাঠামো ও বিনিয়োগ না করাই ভালো।’

সমাধান যেভাবে

ডলার–সংকটের কারণে গত এপ্রিল থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে যে পরিমাণ ঘাটতি ছিল, সেই পরিমাণ ডলার বিক্রি করেনি। ফলে ব্যাংকগুলো বেশি দাম দিয়ে বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় আনতে শুরু করে। এতে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। গত এপ্রিলে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। এখন ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয়ে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত দাম দিচ্ছে।

ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকগুলোকে। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) রপ্তানিতে ডলারের দাম ৯৯ টাকা এবং প্রবাসী আয় ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে।

এই দুই দামের গড়ের চেয়ে ১ টাকা বেশি দামে আমদানি খরচে ডলারের দাম ধরছে ব্যাংকগুলো। ফলে ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি আপাতত থেমে গেছে। এদিকে আমদানিও কমছে। বাড়ছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়।

বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের সরবরাহ বাড়ছে, চাহিদাও কমছে। ফলে দাম কমে আসছে। মাঝে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো হয়েছিল। ডলারের দাম নিয়ে যে ভয় ছিল, তা কেটে গেছে, সংকটও ধীরে ধীরে কেটে যাবে।

এখনো বিভ্রান্তি

রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রির ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার উঠেছিল, এখন যা কমে হয়েছে ৩ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে রিজার্ভ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করায় এ পরিস্থিতি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে ৯৬ টাকা দামে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আন্তব্যাংকে ডলার বেচাকেনার দাম উল্লেখ আছে ১০১-১০৩ টাকা। একইভাবে রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়নের ওপর উল্লেখ থাকলেও প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং প্রকৃত রিজার্ভ ও ডলারের দাম—দুটো নিয়েই রয়েছে নানা বিভ্রান্তি।

এদিকে প্রতিবেশী ভারতের যে রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে দেশটি ১৫ মাসের আমদানি দায় মেটাতে পারবে। সুইজারল্যান্ড তাদের রিজার্ভ দিয়ে ৩৯ মাসের, জাপান ২২ মাসের, রাশিয়া ২০ মাসের ও চীন ১৬ মাসের আমদানি দায় মেটাতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের অর্থ ডলারের পাশাপাশি বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ করে রেখেছে। আবার রিজার্ভের অর্থে দেশেও তহবিল গঠন করেছে। রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার (৭ বিলিয়ন) দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল। রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)।

উড়োজাহাজ কিনতে বাংলাদেশ বিমান ও সোনালী ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়েছে। পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেওয়া হয়েছে। এসব মিলিয়ে ব্যবহার হয়েছে আট বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) রিজার্ভের হিসাবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভকে হিসাব করতে বলেছে।