চলতি বছরে বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১.৯%: জাতিসংঘ

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

চলতি বছরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে ১ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসতে পারে। বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির অর্থনৈতিক ও সমাজিক–বিষয়ক বিভাগ এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সংস্থাটি বলছে, ইউক্রেনে যুদ্ধের ফলে খাদ্য ও জ্বালানি নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাস মহামারির চলমান প্রভাব, ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে।

ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে একটি বিষণ্ন ও অনিশ্চিত অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে জাতিসংঘ বলেছে যে উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় ধরনের দেশই একটা খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে অনেকগুলো ২০২৩ সালে মন্দার ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে।

‘বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা’ শিরোনামের ১৭৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনের ভূমিকায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা সরবরাহে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও অনিশ্চয়তা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বিস্তৃত পরিসরে বড় ধরনের মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। সেখান থেকে এ বছর প্রবৃদ্ধি নেমে আসতে পারে ১ দশমিক ৯ শতাংশে। এটি হবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধির হারগুলোর মধ্যে একটি।

তবে আগামী বছর বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আবার কিছুটা বাড়বে বলে আভাস দিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মতে, ২০২৪ সালে ২ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে। তবে এটা সম্ভব হবে যদি বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমে আসে এবং অর্থনীতির উন্নয়নের বাধাগুলো দূর হতে থাকে।

এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। সেখানে তারা বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ করেছে।

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১ শতাংশ বা তার বেশি বলা হয়েছে। গত অক্টোবরে সংস্থাটি জানিয়েছে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালে ৬ শতাংশ থেকে কমে ২০২২ সালে ৩ দশমিক ২ শতাংশ হয়। আর এ বছর তা আরও কমে ২ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে।

আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় বলেন, ২০২৩ সাল একটি কঠিন বছর হবে। তবে আমরা বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা করি না।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির দেশের প্রবৃদ্ধির গতি দুর্বল হয়েছে, যার বিরূপ প্রভাব বিশ্বের বাকি দেশগুলোয় পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরে মাত্র দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে, গত বছর যা ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ইইউতে গত বছরের ৩ দশমিক ৩ শতাংশের প্রবৃদ্ধি চলতি বছরে কমে মাত্র দশমিক ২ শতাংশে নামতে পারে, যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে যা হতে পারে দশমিক ৮ শতাংশ। এ ছাড়া ইউরোপের অনেক দেশে ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ একটি হালকা মন্দাবস্থা দেখা দিতে পারে।

অন্যদিকে চীনের কমতে থাকা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এ বছর বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শূন্য কোভিড নীতি ত্যাগের কারণে দেশটির অর্থনীতি ভালো করছে। এ কারণে প্রবৃদ্ধি বেড়ে এ বছরে ৪ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, ২০২২ সালে যা ছিল ৩ শতাংশ।

বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে জাতিসংঘ। তবে এ বছর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি অনুমান করা হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এই হার ২০৩০ সালের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে অনেক কম বলে মনে করে জাতিসংঘ।

দক্ষিণ এশিয়ায়ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমবে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, খাদ্য ও জ্বালানির উচ্চ মূল্য, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে দক্ষিণ এশিয়ার গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি দশমিক ৮ শতাংশ কমে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। এই অঞ্চলের দেশ ভারতে গত বছরের ৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্য পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জিং হবে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে সহায়তা চেয়েছে, তা জাতিসংঘ উল্লেখ করেছে।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো বর্তমানে চড়া দামে জ্বালানি তেল বিক্রি করছে। পাশাপাশি পর্যটন খাতের বিকাশের ফলেও ভালো অবস্থানে আছে দেশগুলো। তবে পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য দেশ, যাদের অর্থনীতি তেলনির্ভর নয়, তাদের আর্থিক সক্ষমতা অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে সাড়ে ৩ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চলতি বছরে আফ্রিকা অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি দশমিক ৩ শতাংশ কমলেও দেশগুলো একাধিক বড় ধাক্কার মধ্য দিয়ে যাবে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। প্রধান বাণিজ্য অংশীদার চীন ও ইউরোপে আফ্রিকার পণ্যের চাহিদা কমেছে, বিপরীতে জ্বালানি ও আমদানি করা খাদ্যের দাম অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধ ও প্রতিকূল আবহাওয়া নিয়েও সংকটে থাকবে মহাদেশটির দেশগুলো।

লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের প্রবৃদ্ধিও কমে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকোসহ ওই অঞ্চলের দেশগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি হ্রাস ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে বিশ্বে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য বাড়ছে বলে জানানো হয়েছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে। সংস্থাটির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও নীতি বিভাগের পরিচালক শান্তনু মুখার্জি জানান, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষের গড় আয় ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশের আয় কমেছে দশমিক ৫ শতাংশ।

বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ ব্যক্তি এখন গড়ে নিম্নবিত্তদের তুলনায় ৪২ গুণ বেশি উপার্জন করে।