সরবরাহব্যবস্থার বিশৃঙ্খলায় বাজারে অস্থিরতা

কয়েক মাস ধরে চিনির বাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না।

দেশে চিনির বাজারে অস্থিরতার জন্য ‘সরবরাহব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা’কে দায়ী করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। সংস্থাটি বলছে, চিনিকলগুলো তাদের সক্ষমতার চেয়ে বেশি সরবরাহের আদেশ নেওয়ায় বাজারে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কারণ, সাপ্লাই অর্ডার বা সরবরাহ আদেশ (এসও) হাতবদলের সুযোগ থাকায় অতি মুনাফার জন্য বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়।

ট্যারিফ কমিশন সম্প্রতি চিনির বাজারের অস্থিরতা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানিয়েছে। এতে চিনির সরবরাহব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে পরিশোধিত চিনির সরবরাহব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে বলা হয়েছে। সংস্থাটির মতে, পরিশোধন মিল থেকে চিনি সরবরাহে বিশৃঙ্খলার ফলে সৃষ্ট সমস্যা বাজারে চিনির মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া দেশে চিনি পরিশোধনাগার কম থাকার কারণেও বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

প্রতিবেদনে বিটিটিসি বলেছে, চিনিকল থেকে এসওর (সরবরাহ আদেশ) মেয়াদ ১৫ দিন উল্লেখ করা হলেও তা অনেক ক্ষেত্রে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে। ফলে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের এসও বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এ ছাড়া মিল থেকে উৎপাদন সক্ষমতার বেশি এসও দেওয়া হয়। আবার এসও হাতবদলের সুযোগ রয়েছে। এতে অতি মুনাফার জন্য কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়, আর সেটি বাজারে সমস্যার সৃষ্টি করে।

‘মঙ্গলবার (১৬ মে) সকালে গিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মেঘনা গ্রুপের চিনিকল থেকে একটি ট্রাকে ১৬ টন চিনি নিয়ে এসেছি। তবে মাঝেমধ্যে চিনি নেওয়ার জন্য সপ্তাহের ওপর বসে থাকার অভিজ্ঞতা আছে।’ 
এস এম শরিফুল ইসলাম, ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী মেসার্স ইয়াছিন স্টোরের স্বত্বাধিকারী

সরকারি সংস্থাটি বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থাকলে মিলগুলো আগের এসওর চিনি সরবরাহ কমিয়ে নতুন এসওর মাধ্যমে সরবরাহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এটি চিনির মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমতে শুরু করলে তখন মিল থেকে এসও কেনা ব্যবসায়ীরা চিনি উত্তোলন করতে চান না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে চিনির সরবরাহে।

বিটিটিসি জানায়, চিনিকলগুলো অনেক সময় নিয়মিত সরবরাহ আদেশের পাশাপাশি বিশেষ সরবরাহ আদেশ নেয়। এই আদেশের মাধ্যমে মূলত বাড়তি দামের চিনি আগে মিল থেকে ছাড় করা হয়। এতে চিনি সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনেক মিল আবার চিনি সরবরাহের জন্য ট্রাকের নম্বর নির্ধারণ করে দেয়। ওই নম্বরের ট্রাক ছাড়া অন্য কোনো ট্রাককে মিলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এতেও সমস্যা দেখা দেয়। 

এ ছাড়া মিল ফটকে খোলা চিনির মূল্য অতিমাত্রায় পরিবর্তনের ফলে সেকেন্ডারি বাজারে প্রতিনিয়ত দাম পরিবর্তন হয়। ফলে খোলা চিনির দাম নিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। খোলা চিনি পাইকারি বাজারে প্রবেশের পর সেটি কোন ব্র্যান্ডের, তা বোঝা যায় না। আর দেশে চিনি পরিশোধনকারী কারখানার সংখ্যা কম হওয়ায় চিনির বাজারে সিন্ডিকেটের সুযোগ আছে।

এসব সমস্যার সমাধানে কিছু ধারণা দিয়েছে বিটিটিসি। যেমন মিল থেকে উৎপাদন সক্ষমতার বেশি সরবরাহ আদেশ না দেওয়া, মিল ফটকে নির্ধারিত মূল্য কমপক্ষে ১০ দিন স্থিতিশীল রাখা এবং চিনির আমদানি শুল্ক কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া।

মাসখানেক আগেও মিল থেকে সময়মতো চিনি পাওয়া যাচ্ছে না, এমন অভিযোগ ছিল পাইকারি ব্যবসায়ীদের। এখন অবশ্য সেই অবস্থা নেই। এ নিয়ে ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী মেসার্স ইয়াছিন স্টোরের স্বত্বাধিকারী এস এম শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মঙ্গলবার (১৬ মে) সকালে গিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মেঘনা গ্রুপের চিনিকল থেকে একটি ট্রাকে ১৬ টন চিনি নিয়ে এসেছি। তবে মাঝেমধ্যে চিনি নেওয়ার জন্য সপ্তাহের ওপর বসে থাকার অভিজ্ঞতা আছে।’ 

পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সরকার চিনির দাম বেঁধে দিতে শুরু করে। ওই সময় থেকে চিনির বাজারে অস্থিরতা বাড়তে শুরু করে। কারণ, সরকার সর্বোচ্চ খুচরা দাম বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি মিল ফটকের মূল্যও জানিয়ে দিত। সরকারের নির্ধারিত এই দামের সঙ্গে মিলের মালিকদের ইস্যু করা এসওর দামে পার্থক্য থাকত। ফলে মিল থেকে চিনি বের হতো কম।

গত বছরের শেষ দিকে গ্যাসের সংকট শুরু হয়। তখন মিল ফটকে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকেও অনেক ব্যবসায়ী চিনি পাননি বলে অভিযোগ ওঠে। তখন চিনির নিয়মিত এসওর পরিবর্তে বিশেষ সরবরাহ আদেশের মাধ্যমে চিনি ছাড়ে মিলগুলো। তাতে সরকারি দাম ও বাজারদরে বড় একটা পার্থক্য থাকত। সরকার নির্ধারিত দামে চিনি না ছাড়ার পাশাপাশি মিল থেকে পাকা রসিদ না দেওয়ার অভিযোগও ওঠে।

চিনিকলের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন গত মাসে সরকারকে জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। সে জন্য চিনির দাম সমন্বয় করতে চান তাঁরা। প্রতি কেজি পরিশোধিত খোলা চিনি ১২৫ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫ টাকা প্রস্তাব করে সংগঠনটি। এরপর সরকার বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে মিলের মালিকদের প্রস্তাবের চেয়ে একটু কমিয়ে দাম বেঁধে দেয়। ঋণপত্র (এলসি), খরচ ও মুনাফা ইত্যাদি হিসাব করে সরকার চিনির প্রতি কেজি দাম নির্ধারণ করলেও তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি মিলের মালিকেরা। 

বর্তমানে মিলগুলো সরকার নির্ধারিত খুচরা দামের কাছাকাছি দামে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে চিনি বিক্রি করছে। সে জন্য খুচরায় চিনির দাম বেশ বেড়ে যাচ্ছে।

এদিকে মিলের মালিকদের নিয়ে ১১ মে ঢাকায় সচিবালয়ে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে ‘চিনির বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং মজুত পরিস্থিতি’ শীর্ষক এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), শিল্প মন্ত্রণালয়, বিটিটিসি, বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা, অপরাধ তদন্ত বিভাগ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রতিনিধিসহ বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববাজার থেকে চিনি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার পর দেশে চিনি আসতে দুই থেকে তিন মাস সময় লেগে যায়।

দেশের চিনির বাজার স্থিতিশীলতার দিকে রয়েছে দাবি করে অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, বাজার আর অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা নেই। দ্রুত সময়ে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

চিনিতে বিশ্ববাজারের প্রভাব

দেশে বর্তমানে চিনি পরিশোধনাগার আছে মাত্র পাঁচটি—সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম। এসব প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে কারখানায় পরিশোধনের পর বাজারজাত করে। সরাসরি পরিশোধিত চিনি আমদানি করে খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বছরে কমবেশি ২১ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়। দেশে উৎপাদিত হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টন; অর্থাৎ চিনির বাজার প্রায় পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভরশীল।

দেশে চিনির আমদানি কমেছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাস জানুয়ারি-এপ্রিলে চিনি আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৩৮ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের সাড়ে ১০ লাখ টনের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বা ৩ লাখ টন কম।

বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে চিনির দাম বাড়ছে। এ বছর জানুয়ারিতে প্রতি টন কাঁচা চিনি আমদানি হয় ৪৭০ ডলারে, যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে এপ্রিলে দাঁড়ায় ৫৩০ ডলারে; অর্থাৎ চার মাসে বিশ্ববাজারে চিনির প্রতি টনে দাম বেড়েছে ৬০ ডলার।

বিটিটিসি সরকারকে জানিয়েছে, ২০২২ সালের মে মাসের শুরুতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি বেচাকেনা হয়েছে ৪২০ ডলারে। এ বছরের মে মাসে এসে সেই দাম বেড়ে ৫৮০ ডলারে উঠেছে; অর্থাৎ এক বছরে চিনির প্রতি টনে দাম ১৬০ ডলারের মতো বেড়েছে। এদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও চিনির দাম বেড়েছে। যেমন গত বছর ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল ৯০ টাকা, যা এবার ১১০-১১১ টাকায় উঠেছে। 

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকায় দেখা যায়, ঢাকার বাজারে এখন প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়, যা এক মাস আগেও ছিল ১১২ থেকে ১১৫ টাকা। আর গত বছরের এই সময়ে চিনির কেজি ছিল ৭৮ থেকে ৮২ টাকা; অর্থাৎ এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে ৬৯ শতাংশ।

উল্লেখ্য, দেশের চিনির বাজারে বেশ কয়েক মাস ধরে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না। যেমন গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত সরকার ছয় দফা চিনির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, কিন্তু একবারও এসব দাম কার্যকর হয়নি। সরকার এক দফা চিনির শুল্কও কমিয়েছে। তাতেও কাজ হয়নি।

সরকার চলতি মাসে সর্বশেষ প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ১২০ টাকায় বেঁধে দেয়। অথচ খুচরা বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। প্যাকেটজাত চিনিতে লাভ কম হয় বলে খুচরা ব্যবসায়ীরা তা বিক্রি করতে চান না। সুপারশপগুলো অবশ্য প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি করে ১২৫ টাকা কেজি দরে।