বিজ্ঞাপন পরিষেবা সীমিত করার কী প্রভাব পড়বে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায়

ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা এখন বাংলাদেশে বেশ বড় হয়েছে। বিভিন্ন পণ্য আরও বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পেজের প্রচার বাড়ায় বা বুস্ট করে। অন্যদিকে অনেক প্রতিষ্ঠান সরাসরি বিজ্ঞাপনও দিয়ে থাকে ফেসবুকে। এ জন্য ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা তাদের হয়ে স্থানীয়ভাবে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করার জন্য এইচটিটিপুল বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়।

প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তবে গত মঙ্গলবার ডলার–সংকটের কথা বলে তারা বিজ্ঞাপন নেওয়া কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর (এফ-কমার্স) মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বিকল্প হিসেবে ক্রেডিট কার্ডে বিজ্ঞাপনের অর্থ পরিশোধে ঝুঁকবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সবাই।

এইচটিটিপুল বাংলাদেশ লিমিটেড মূলত স্থানীয় বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে টাকায় বিজ্ঞাপনের অর্থ সংগ্রহ করত। সেই অর্থ মেটাকে, অর্থাৎ ফেসবুককে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ডলারে পরিশোধ করত। এইচটিটিপুল যে চিঠির মাধ্যমে তাদের বিজ্ঞাপনী কার্যক্রম সীমিত করার কথা জানিয়েছে, সেখানে প্রতিষ্ঠানটি উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ডলার না পাওয়ার ফলে তারা মেটাকে বিজ্ঞাপনের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। তবে প্রতিষ্ঠানটি এ–ও জানিয়েছে যে তারা এ সমস্যার সমাধানে আন্তরিকভাবে কাজ করছে।

এসব কারণে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া কমবে বলেই সংশ্লিষ্ট সবাই মনে করছেন। এইচটিটিপুল তাদের গ্রাহকদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, পরবর্তী নোটিশ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে মেটার বিজ্ঞাপন–সংক্রান্ত পরিষেবা সাময়িকভাবে পাওয়া যাবে না অথবা সীমিত থাকবে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সানি নাগপাল স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ডলার-সংকট ও বিদেশে টাকা পাঠানো নিয়ে জটিলতার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এইচটিটিপুলের এ ঘোষণার পর এফ-কমার্সভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তারা বিজ্ঞাপনের অর্থ কীভাবে পরিশোধ করবে। কারণ, বিজ্ঞাপন না দিতে পারলে এফ-কমার্স তো বটেই, বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের বেচাকেনায় নিশ্চিতভাবে প্রভাব পড়বে।

এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে কুরিয়ার কার্যক্রম। ফলে তাদের বিক্রি কমার মানেই হলো তা স্থানীয় কুরিয়ার ব্যবসাকেও প্রভাবিত করবে। ব্যবসা খারাপ হবে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোরও।

তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়তে পারে, এমন ধারণা করা হলেও এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে বলে মনে করেন ই–কমার্সের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, প্রথমত, যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা হবে, তাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, একটি কার্ডের মাধ্যমে যেহেতু প্রতিবছর ১২ হাজার ডলারের বেশি আন্তর্জাতিক মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ নেই, তাই যাদের বড় পরিমাণ অর্থ বিজ্ঞাপনী খরচ হিসেবে মেটাকে দিতে হয়, তাদের অর্থ পরিশোধ জটিল হয়ে পড়বে।

এ ক্ষেত্রে অবশ্য তুলনামূলক সুবিধা পাবে ছোট এফ-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কার্ড না থাকলে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।

এ ব্যাপারে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সহসভাপতি মো. সাহাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এইচটিটিপুল মেটার স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি তারাও এ দেশে তাদের হয়ে কাজ করার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় মুদ্রায় অর্থ নিয়ে বিজ্ঞাপনের কাজটি করে দেওয়ায় দেশের এফ-কমার্স খাতের দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছিল। তাই এইচটিটিপুলের সিদ্ধান্ত কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

দেশে এফ-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩ থেকে ৫ লাখ হবে উল্লেখ করে সাহাব উদ্দিন বলেন, নিয়মিত ব্যবসার পাশাপাশি উৎসবকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা মূলত মেটা প্ল্যাটফর্মে দেওয়া বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে বেশ ভালো ব্যবসা করে থাকে। তাই সমস্যার সমাধান না হলে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা হারাবেন। আর ক্রেডিট কার্ড ভালো বিকল্প হলেও তাতে সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। তাতে সাময়িকভাবে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার করা গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা কতটুকু কাজে আসবে, তা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।

সমস্যা সমাধানে ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান এই উদ্যোক্তা।

এইচটিটিপুলের সিদ্ধান্তের কারণে দেশে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা বাড়বে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসার পরিবেশ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেদিকটি বিবেচনায় এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এইচটিটিপুলের এই সিদ্ধান্তে সাময়িক সময়ে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবসা বাড়লেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা না দিতে পারলে অর্থনীতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি।