পাট খাতে নগদ সহায়তায় কারসাজি জেনেও ‘নীরব’ মন্ত্রী

  • রপ্তানিতে নগদ সহায়তায় ব্যয় বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা।

  • পাট খাতে নগদ সহায়তায় বরাদ্দ ৫০০ কোটি টাকা।

  • কোনো পাটপণ্যে নগদ সহায়তা ৭%, কোনোটিতে ২০%।

  • সহায়তার হার সমান করলে কারসাজি বন্ধ হবে।

ফাইল ছবি প্রথম আলো

রপ্তানিতে বাড়তি ভর্তুকি বা নগদ সহায়তা হাতিয়ে নিতে কারসাজি করার অভিযোগ উঠেছে বেশ কিছু পাটপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তারা সাধারণ পাটপণ্যকে বিশেষ ধরনের পণ্য হিসেবে দেখিয়ে রপ্তানি করছে, যাতে নগদ সহায়তা বেশি নেওয়া যায়।

কোনো কোনো পাটপণ্যে সরকার প্রতি ১০০ টাকা রপ্তানির বিপরীতে ৭ টাকা ভর্তুকি দেয়, কোনোটিতে দেয় ২০ টাকা। সরকারের অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ ও ব্যবসায়ীদের দাবি, সাধারণ পাটপণ্যকে বিশেষ পাটপণ্য হিসেবে রপ্তানি দেখিয়ে বিগত চার অর্থবছরে এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি নগদ সহায়তা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এখন এ ব্যাপারে হাত দেওয়া যাবে না। এতে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে।
গোলাম দস্তগীর গাজী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী

পাটপণ্য রপ্তানিতে যে কারসাজি হচ্ছে, তা নিয়ে সোচ্চার এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠনই। তারা জালিয়াতি বন্ধ করতে পাট মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে গেছে। অভিযোগের বিষয়টি জানেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। অজানা নয় পাটসচিব আব্দুর রউফেরও। কিন্তু তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি।

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানের একটি পর্যায়ে গত ২০ ডিসেম্বর পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ভর্তুকির অপব্যবহার যে হচ্ছে, তা কিছুটা জানি। কিন্তু এটা তো ঠেকানোর দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই সনদ দেয়।’ পাট খাতের ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য সংগঠন করার সনদ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সেটির কথা বলছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ।’

পাটমন্ত্রীকে তখন জানানো হয়, যে প্রজ্ঞাপন ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা বেআইনিভাবে ভর্তুকি নিচ্ছেন, সেটা জারি করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। পরে মন্ত্রী বলেন, ‘এখন এ ব্যাপারে হাত দেওয়া যাবে না। এতে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে।’

সাধারণ পাটপণ্যকে বিশেষ পাটপণ্য দেখিয়ে ২০% হারে নগদ সহায়তা নিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ তুলেছে ব্যবসায়ীদের সংগঠনই।

সচিব আব্দুর রউফের বক্তব্যও একই ধরনের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলারসংকটের এ সময়ে আমাদের রপ্তানি আয় দরকার। ফলে যাঁরা রপ্তানি করছেন না, তাঁদেরও একইভাবে করা উচিত।’ অনিয়ম দূর করার পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তিনি বলেননি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অবশ্য এ নিষ্ক্রিয়তার কারণে জনগণের করের টাকা আত্মসাৎ হচ্ছে। অন্যদিকে যাঁরা কারসাজি করছেন না, সেই রপ্তানিকারকেরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। কারও কারও কারখানা বন্ধের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।

কারসাজি যেভাবে

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পণ্য রপ্তানি। অন্য দেশের চেয়ে দেশীয় পণ্যকে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখা, পিছিয়ে থাকা পণ্যকে সহায়তা এবং নতুন পণ্য ও নতুন বাজারে রপ্তানিতে উৎসাহ দিতে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। এখন ৪৩ ধরনের পণ্য নগদ সহায়তা পায়, হার ১ থেকে ২০ শতাংশ। নগদ সহায়তা দিতে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাটপণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা বাবদ বরাদ্দ ৫০০ কোটি টাকা।

পাট মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বৈচিত্র্যপূর্ণ পাটপণ্যের ২৮২টি ধরন রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর মধ্যে তিনটিতে কারসাজি বেশি হচ্ছে। সেই তিন ধরন হলো গার্ডেন টোয়াইন (পাটের বিশেষ ধরনের মোটা সুতা), কেব্‌ল ইয়ার্ন (বিশেষ ধরনের সরু সুতা) ও ফুড গ্রেড ইয়ার্ন (সরু সুতা, যা দিয়ে খাদ্যপণ্য বহন করার বস্তা তৈরি হয়)। এই তিন ধরনে নগদ সহায়তার হার ২০ শতাংশ। অসাধু রপ্তানিকারকেরা যেসব পাটপণ্য ৭ শতাংশ নগদ সহায়তা পাওয়ার যোগ্য, সেগুলোকে এই তিন ধরনের পণ্য হিসেবে দেখিয়ে রপ্তানি করছেন।

অভিযোগ ২৭ কারখানার বিরুদ্ধে

কারসাজিতে জড়িত কারখানাগুলোর বেশির ভাগ বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) সদস্য। সংগঠনটির সদস্যসংখ্যা ৮২। এর মধ্যে উৎপাদনে আছে ৩৫টি। বিজেএসএর নেতাদের অভিযোগ, সদস্যদের মধ্যে ২৭টি প্রতিষ্ঠান কারসাজি করে নগদ সহায়তা নিচ্ছে।

মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছে যদি অনিয়মের অভিযোগ যায়, তাঁদের দায়িত্ব হলো তা খতিয়ে দেখা।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে পাটসুতা ‘ফুড গ্রেডের’ কি না, তা পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে এ সুতায় সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। সাধারণ সুতাকে ‘ফুড গ্রেডের’ সুতা দেখিয়ে রপ্তানির অভিযোগের বিষয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জানতে চাইলে তারা অভিযোগ অস্বীকার করে। যেমন লক্ষ্মণ জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৌমেন ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদা থাকায় তাঁরা হাইড্রোকার্বন মুক্ত করে এখন ‘ফুড গ্রেড জুট ইয়ার্ন’ (ভেজিটেবল ওয়েল ট্রিয়েটেড বা ভিওটি নামেও পরিচিত) উৎপাদন করছেন।

কাস্টমসের হিসাব বলছে, রোমান জুট মিলস চার মাসে ‘ফুড গ্রেড জুট ইয়ার্ন’ রপ্তানি দেখিয়েছে ৯০০ টন। জানতে চাইলে রোমান জুট মিলসের পরিচালক রাকিবুল ইসলাম গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ভিওটি উৎপাদন ও রপ্তানি করেই ভর্তুকি নিচ্ছেন। অভিযোগকারীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে কথা বলে থাকতে পারেন।

বিজেএসএ বলছে, ২০২০ সালের পর থেকে পাটসুতা রপ্তানি কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে, বিপরীতে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে ভিওটি রপ্তানি। কেন এমন হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই সব বেরিয়ে আসবে। বিজেএসএ গত জানুয়ারিতে এনবিআরের কাছে মিথ্যা ঘোষণায় নগদ সহায়তা আত্মসাৎ রোধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করে। সংগঠনটি বলছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ফাঁকফোকর প্রজ্ঞাপনে

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বহুমুখী পাটপণ্যের একটি তালিকা তৈরি করে পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর ২৮২টি বৈচিত্র্যপূর্ণ বা বহুমুখী পাটপণ্যের নাম উল্লেখসহ প্রজ্ঞাপন জারি করে।

প্রজ্ঞাপনে একটি ক্ষেত্রে চারটি পণ্যের নাম একটি শ্রেণিতে উল্লেখ করা হয়—ফুড গ্রেড ব্যাগস/ ক্লথ/ ইয়ার্ন/ টোয়াইনস। আরেকটিতে তিনটি পণ্যকে একই শ্রেণিতে উল্লেখ করা হয়—ওয়্যার/কেব্‌ল/ফিউজ ইয়ার্ন। একই শ্রেণিতে উল্লেখ করা আলাদা পণ্যগুলোর বিপরীতে নগদ সহায়তার হার ভিন্ন। কিন্তু যেহেতু একই শ্রেণিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেহেতু কম হারের নগদ সহায়তার পণ্য রপ্তানি করে বেশি হারে সহায়তা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

যেমন ‘ফুড গ্রেড ব্যাগস/ ক্লথ/ ইয়ার্নের’ মধ্যে ইয়ার্নের নগদ সহায়তা ৭ শতাংশ। ফুড গ্রেড ব্যাগের ক্ষেত্রে তা ২০ শতাংশ। বিজেএসএ বলছে, ফুড গ্রেড ব্যাগ বাংলাদেশে সামান্যই উৎপাদিত হয়। তার বিপরীতে উচ্চ হারে নগদ সহায়তা দেওয়া বেআইনি। অভিযোগ আছে, যেসব পণ্য দেশে তেমন একটা উৎপাদন হয় না, সেগুলোর নাম প্রজ্ঞাপনে রাখার পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের তদবির ছিল।

জেডিপিসির নির্বাহী পরিচালক মেহমুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দেওয়ার আগের প্রজ্ঞাপন এটি। বিষয়টি নিয়ে তিনি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবেন।

নিয়ম রয়েছে বিজেএসএ এবং বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) যেকোনো একটির সনদ হলেই রপ্তানি ভর্তুকির টাকা নেওয়া সম্ভব। জালিয়াতি ধরা পড়ার পর বিজেএসএ সনদ দিচ্ছে না। তবে এখন দিচ্ছে বিজেএমএ। অনেকেই দুই সংগঠনের সদস্য।

বিজেএসএর চেয়ারম্যান সেখ নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নগদ সহায়তার তিনটি হারের বদলে একটি করা হলে এ মহা দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে।

‘খতিয়ে দেখা দায়িত্ব’

২০২১-২২ অর্থবছরে পাট খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে প্রায় ১১৩ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩ শতাংশ কম। পাট একসময় দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাত ছিল।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, নগদ সহায়তার এসব অসাধু কাজের সঙ্গে ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও সরকারি কর্মকর্তারাও জড়িত থাকেন। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছে যদি অনিয়মের অভিযোগ যায়, তাঁদের দায়িত্ব হলো তা খতিয়ে দেখা।