সম্পদ বাড়াতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করা হচ্ছে

সানেম আয়োজিত ইকোনমিস্ট কনফারেন্সে বক্তব্য দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। গতকাল রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনেছবি: প্রথম আলো

ক্ষমতা ধরে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যবস্থাপনায় বাঁকবদল হচ্ছে। রাজনীতি প্রতাপশালী দলের একক কর্তৃত্ব বা ডমিনেন্ট পার্টি স্টেট (ডিপিএস) ব্যবস্থায় যাচ্ছে নাকি ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, এমন প্রশ্নও উঠেছে। আবার দেশে সত্যিকার রাজনৈতিক দল আছে, না কি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে (ডাইনেস্টি) প্রাধান্য দিচ্ছে? সার্বিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর দর্শন ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ইকোনমিস্ট কনফারেন্সের গতকাল শনিবারের সকালের অধিবেশনে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি আগামীকাল শেষ হবে।

‘প্রতাপশালী রাজনৈতিক দলের একক কর্তৃত্বের উত্থান এবং বিকাশ: গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পরিণাম কী’ শীর্ষক এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান। এই অধিবেশনে বিশেষ বক্তা ছিলেন সিপিডির চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক মির্জা এম হাসান।

সম্পদ বাড়াতে রাজনীতিকে ব্যবহার

অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তব্যে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রবেশ; রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে ফেলা; খেলাপি ঋণ—এসব বিষয় উঠে আসে। তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পদ বাড়ানোর জন্য একশ্রেণির ব্যবসায়ী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করেন। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় বাজারে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা খেলাপি ঋণের সুযোগ নেন। ঋণখেলাপি হওয়া এখন একটি ব্যবসায় মডেল হয়ে গেছে। টাকা ধার নিয়ে সুদ ছাড়া পরিশোধ করা যায়। এটি তাঁদের প্রতিযোগিতার বাজারে এগিয়ে দিচ্ছে।’

রেহমান সোবহানের মতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন রাজনৈতিক ক্ষমতা লাগে। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। একই আইন সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর হয় না। আইনকানুন বাছাই করা লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এসব ঠিক করে দেয় রাজনৈতিক সংযোগ। দেশের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষার জন্য এ পরিস্থিতি খুবই ভয়ংকর।

১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচনে একবার বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে, একবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বলেন, এর মাধ্যমে বহুদলীয় ব্যবস্থার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা বিদেশে প্রশংসা পায়।

রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে

মির্জা এম হাসান তাঁর মূল প্রবন্ধে বলেন, প্রতাপশালী রাজনৈতিক দলের একক কর্তৃত্ব বা ডমিনেন্ট পার্টি স্টেট (ডিপিএস) ব্যবস্থায় রূপান্তর হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। বাংলাদেশ কি এক রাজনৈতিক দলের দেশে পরিণত হচ্ছে?

নির্বাচনব্যবস্থা সম্পর্কে মির্জা এম হাসান বলেন, ‘নির্বাচন হবে, কিন্তু আমি হারব না—রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এর চেয়ে স্বস্তির আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশে তা-ই হচ্ছে। ক্ষমতাসীনেরা দুটি বিষয়ের ওপর নজর রাখেন। প্রথমত, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ। বর্তমান বিরাজমান পরিস্থিতিতে এটি সমস্যা নয়। আরেকটি হলো ভূরাজনৈতিক ইস্যু। এটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভালোভাবে সামাল দিয়েছে।’ তিনি বলেন, বিএনপির সমর্থন পুরোপুরি আন্তর্জাতিক নির্ভর। কিন্তু স্থানীয় সমর্থন নিয়ে বিএনপি কিছু করতে পারল না। ক্ষমতাসীনেরা বিএনপিকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদি বিএনপিকে ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো কর্তৃত্ববাদী ডমিনেন্ট পার্টি স্টেট হয়ে যাবে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে শুধু অর্থনৈতিক বৈধতা নয়; গণতন্ত্রের বৈধতাও লাগে।

মির্জা এম হাসান আরও একটি দিক তুলে ধরেন। তাঁর মতে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ল কি না; সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা কতটা বাড়ল—এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেশি।

মির্জা এম হাসান সুশীল সমাজকেও সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তিনি বলেন, এ দেশের সুশীল সমাজ মানবাধিকার, আইনের শাসন নিয়ে বেশি আগ্রহী। কিন্তু গরিব মানুষের খাওয়া-পরার নিশ্চয়তার ইস্যু নিয়ে এগিয়ে আসে না।

অনুষ্ঠানের সভাপতি রওনক জাহান সূচনা বক্তব্যে বলেন, রাজনীতি প্রতাপশালী দলের একক কর্তৃত্ব বা ডমিনেন্ট পার্টি স্টেট ব্যবস্থায় যাচ্ছে, না কি ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, এমন প্রশ্নও উঠেছে। আবার দেশে সত্যিকার রাজনৈতিক দল আছে, না কি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে প্রাধান্য দিচ্ছে? সব দলের দর্শন যেন ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে এত স্বতন্ত্র প্রার্থী পাস করল কেন, এ সম্পর্কে রওনক জাহান বলেন, ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে নিয়ন্ত্রণ থাকছিল না। তাই ‘ছেড়ে দেওয়া’ই ভালো এমন মনোভাব থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন করতে দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, ২০১৪ সাল থেকে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা উঠে গেছে। ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সফল হয়েছে। চীনের সহায়তা নিয়ে পদ্মা সেতু করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। যুক্তরাষ্ট্র এখন চাইলেই কিছু করতে পারে না।

এম এম আকাশের মতে, রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলারা শক্তিশালী হয়ে গেছে। তারা ছাড়া নির্বাচনে জেতা যাচ্ছে না। বড় ব্যবসায়ীরা ঠিক করে দেন, কে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হবেন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) গবেষক আশিকুর রহমান বলেন, ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি ভালো নির্বাচন হওয়ার পরও কেন আমরা গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে পারলাম না? আসলে ‘উইনার টেক অল’ নীতির কারণে এমন হয়েছে। ২০০১ সালে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ ৬২টি আসন পেয়েছে। আবার ২০০৮ সালে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপি মাত্র ৩২টি আসন পেয়েছে।