ব্যবসায়ীদের প্রতি এফবিসিসিআই: ‘কালো ব্যবসা’ বন্ধ করুন

পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। আজ রোববার মতিঝিলে এফবিসিসিআইয়ের কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসায়ীদের প্রতি ‘কালো ব্যবসা’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, পণ্য কেনাবেচার সময় রসিদ না দেওয়া কিংবা এক দামের রসিদ দিয়ে অন্য দাম নেওয়া—এগুলো ব্যবসায়ের কালো অধ্যায়। লাভ করবেন আর কাগজ দেবেন না, এটা হবে না।

নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের বিভিন্ন পর্যায়ের বিক্রিতে সঠিক দাম উল্লেখ করে রসিদ দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে পাইকারি ও উৎপাদকদের বচসার মধ্যে এমন কথা বলেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। আজ রোববার বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই বচসার ঘটনা ঘটে। আসন্ন পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে পণ্যের আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে এ সভার আয়োজন করা হয়।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগের মধ্যে জসিম উদ্দিন বলেন, নীতিনৈতিকতা নিয়ে ব্যবসা করতে হবে। খারাপ কিছু মানুষ থাকতে পারে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। অল্প কিছু ব্যবসায়ীর এমন আচরণের কারণে পুরো ব্যবসায়ী সমাজের দুর্নাম হয়।

পণ্যের বিভিন্ন পর্যায়ের বিক্রিতে সঠিক দাম উল্লেখ করে রসিদ না দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে এফবিসিসিআই একটি কমিটি গঠন করে কাজ করবে বলে সভায় ঘোষণা দেন তিনি।

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান, টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান প্রমুখ। এ ছাড়া মেঘনা, সিটি, টিকেসহ বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন খাতের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।  

অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগ

সভায় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাজারে সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পরিশোধিত চিনি ও খোলা ভোজ্যতেল কেন বিক্রি করা হয়? এর উত্তরে তাঁরা বলেন, মিলের মালিকেরা তাঁদের সরকারনির্ধারিত ক্রয়মূল্যের রসিদ দেন না।

তবে মিলমালিকেরা দ্রুতই এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে এটা নিয়ে বচসায় জড়ান উভয় পক্ষের ব্যবসায়ীরা।

পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সভায় জানান, তাঁরা বেসরকারি মিলগুলো থেকে সরকার-নির্ধারিত ক্রয়মূল্যে পরিশোধিত চিনি ও খোলা সয়াবিন তেল কিনতে পারেন না। যে দামে কেনেন, তার সঠিক রসিদও মিলগুলো দেয় না। এ কারণে বাধ্য হয়ে তাদের সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে হয়। কিন্তু কেউ দামের রসিদ চাইলে তাঁরা দেখাতে পারেন না।

বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাশেম বলেন, ‘চিনির দাম কীভাবে নির্ধারণ করা হয়, পাইকারি ব্যবসায়ী হিসেবে তা আমরা জানি না। আবার সরকারনির্ধারিত মূল্যে আমরা মিল থেকে কিনতেও পারি না। এতে বাধ্য হয়ে বাজারে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করেন অনেকে। তখন আবার জরিমানা গুনতে হয়। এ সমস্যার সমাধানে উৎপাদন (মিল), পাইকারি ও খুচরা—তিন পর্যায়েই দাম সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার দাবি জানান এ পাইকারি বিক্রেতা।

পাইকারি ব্যবসায়ীদের এ অভিযোগের বিষয়ে মিলগুলোর কাছে জানতে চান এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। এর জবাবে মিলগুলোর প্রতিনিধিরা এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তাঁরা সব সময় বিক্রির রসিদ সরবরাহ করেন। সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, যাঁরাই পণ্য কিনছেন, তাঁরা নিয়মিত ক্রয়ের রসিদ নিচ্ছেন। যিনি রসিদ পান না, তিনি তো পণ্যই নেন না। কারণ, রসিদ ছাড়া পণ্য বিক্রি হয় না।

তখন এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, মিলগুলো রসিদ দেয়, এ কথা ঠিক। তবে সরকারনির্ধারিত মূল্যের রসিদ দেয় না। বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, ‘মিলগুলো আমাদের রসিদ দিচ্ছে এক দরে, আর টাকা নিচ্ছে অন্য দরে। এসব সত্য কথা বলার জন্য আবার আমাদের মিলগেটে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’

এ সময় বিষয়টি নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। মিলগুলোর প্রতিনিধিরা বলেন, ‘আপনারা রসিদ (ইনভয়েস) না পেলে পণ্য কিনবেন না। এর উত্তরে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রশ্নটা রসিদ পাওয়া নিয়ে নয়, নির্ধারিত মূল্যের রসিদ পাচ্ছি কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তখন মিলগুলোর প্রতিনিধিদের একজন বলেন, তাহলে আপনি আমাদের থেকে পণ্য নিয়েন না।’

রমজানে দাম বাড়ে, এই বদনাম থেকে বের হতে চাই

সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন আরও বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে উৎসবের সময় পণ্য বিক্রিতে ছাড় দেওয়া হয়। আর আমাদের দেশে উল্টো মূল্য বৃদ্ধি পায়। গত বছরেও রোজার আগে আমরা বিষয়টি নিয়ে সভা করেছিলাম। তারপরও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ বছর তাই আগেই এ সভা ডাকা হয়েছে।’

জসিম উদ্দিন বলেন, ‘অন্তত এ বছর রোজায় দাম বাড়ানো হবে না, এই অভ্যাসটা শুরু করি। বরং পারলে দাম কিছুটা কমাব। রমজান মাস এলে দাম বাড়ে, এই বদনাম থেকে বের হতে চাই।’

সভায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের কাছে কথা বলে জেনেছি, রমজান ও পরবর্তী এক-দুই মাসের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ রয়েছে। সুতরাং সরবরাহের ঘাটতির কারণে মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই।’

বেশি দাম নিলে ও পাকা ভাউচার ছাড়া পণ্য বিক্রি করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি হুঁশিয়ার করে দেন।