দেশ হয়ে যাচ্ছে উচ্চ বৈষম্যপূর্ণ

বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য ধনী-গরিবের কাছ থেকে একই হারে পরোক্ষ কর নেওয়ার কথা সংলাপে ওঠে আসে।

সিপিডি ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিচ্ছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান (বাঁ থেকে তৃতীয়)। গতকাল ঢাকার শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ ধীরে ধীরে খুবই বৈষম্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। সরকারি হিসাবে ২০১০ সালেও ধনী-গরিবের মধ্যে যতটা আয়বৈষম্য ছিল, তা এক যুগের ব্যবধানে ২০২২ সালে এসে আরও বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশ এখন উচ্চ বৈষম্যপূর্ণ দেশ হওয়ার দ্বার প্রান্তে। এখানে ধনী-গরিব একই হারে পরোক্ষ কর দিচ্ছেন—এটিও বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

ঢাকার শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল সোমবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘আইএমএফের সময়কালে অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের কথা জাতীয় বাজেটে কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে’ শীর্ষক এক সংলাপে এ পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সুলতানা কামাল সংলাপটি সঞ্চালনা করেন। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

প্রবন্ধে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট আসছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে সরকার যদি নিজেই এসব সংস্কারে হাত দিত, তাহলে ভালো হতো। কিন্তু ‘বাজেট এখন অনাথ, আর আইএমএফ তার পালক পিতা’।

সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আইএমএফ যখন কোনো দেশে কর্মসূচি নিয়ে যায়, তখন সে দেশের অর্থনীতির ওপর একক কর্তৃত্ব আরোপ করে বা আরোপের চেষ্টা করে। তাদের শর্তের কারণেও অনেক সময় বৈষম্য বেড়ে যায়।

জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে নিম্ন আয় ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ সাতটি বিষয় নিয়ে এখন গভীরভাবে ভাবার আছে বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, ভর্তুকি অনেক সময় ভালো হয়, আবার খারাপও হয়। আর আইএমএফ যে বাড়তি কর আদায়ের কথা বলেছে, এর সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কিন্তু কাদের কাছ থেকে সে কর আদায় করা হবে, সেটাই বড় কথা।

সংলাপের নির্ধারিত আলোচক সিপিডির আরেক বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই বাজেটে সরকারি ব্যয়ের অংশ সবচেয়ে কম। বাজেটের যে আকারের কথা শোনা যাচ্ছে, তা কম। ১২ লাখ কোটি টাকার বাজেট করা উচিত।

আইএমএফের সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক কী? বাজেট আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। আর আইএমএফ হচ্ছে সাইড অ্যাক্টর। আমরা আইএমএফের ওপর নির্ভরশীল নই।
এম এ মান্নান, পরিকল্পনামন্ত্রী

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, সরকারের অনেক উদ্যোগ মানুষ জানেন না। যেমন প্রবাসী শ্রমিকদের বাচ্চাদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। যদিও ২৪ থেকে ২৫টা ধাপ পার হয়ে তা নিতে হয়। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, একটা এলাকায় বাল্যবিবাহ বেশি হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ইমাম, কাজি—তাঁরাই এ ধরনের বিবাহে ভূমিকা রাখছেন। গেলাম কাজির কাছে। তিনি বললেন, ‘মাসে ৪ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পাই। এটা দিয়ে কীভাবে সংসার চালানো সম্ভব?’ সুতরাং সমস্যার গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে কী কারণে কী হচ্ছে, বলেন আসিফ সালেহ।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘পরোক্ষ করের কারণে বৈষম্য বাড়ছে। বেক্সিমকোর মালিকপক্ষ ও রুমিন ফারহানাকে একই হারে পরোক্ষ কর দিতে হয়।’

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার জন্য করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বমন্দা—এ তিনটিকে সরকার অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে আসছে বলে মন্তব্য করেন রুমিন। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে সরকার অর্থ পাচারের কোনো তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে পাচার বন্ধে সরকারের কোনো সদিচ্ছা নেই।

সংলাপে উপস্থাপিত প্রবন্ধে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট আসছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে সরকার যদি নিজেই এসব সংস্কারে হাত দিত, তাহলে ভালো হতো। কিন্তু ‘বাজেট এখন অনাথ, আর আইএমএফ তার পালক পিতা।

প্রবীণ নাগরিক তোফাজ্জল হোসেন মঞ্জু বলেন, বয়স্ক ভাতা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা নয়, যেন এক হাজার টাকা করা হয়।

দলিত শ্রেণির প্রতিনিধি শিপন কুমার রবিদাস বলেন, দেশে ৫৫ লাখ দলিত জনগোষ্ঠী থাকলেও বাজেটে তাদের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা হয় না। আবর্জনা পরিষ্কার করে তাঁরা জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রমিত হচ্ছেন। অথচ তাঁদের চিকিৎসার জন্য হাতুড়ে ডাক্তারই ভরসা।

রূপান্তরিত নারী তানিশা ইয়াসমিন চৌধুরী জানান, নিজের পরিবার থেকে শুরু করে সব জায়গায় তাঁরা বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। সেফ হোম বা নিরাপদ আবাসনের দাবি জানান তিনি।

পরিকল্পনামন্ত্রী যা বললেন

বাজেট বিষয়ে আইএমএফকে ‘সাইড অ্যাক্টর’ বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তাঁর প্রশ্ন, ‘আইএমএফের সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক কী? বাজেট আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। আর আইএমএফ হচ্ছে সাইড অ্যাক্টর। আমরা আইএমএফের ওপর নির্ভরশীল নই। আর “মিশন আসবে, মিশন আসবে” বলে এত কথা বলারও কিছু নেই। বলেছি, আমরা কি এখানে মরে যাচ্ছি যে তোমরা মিশনে আসছ। অনেকে আবার বলেন দাতাগোষ্ঠী। কিসের দাতাগোষ্ঠী? এ শব্দেরও আমি ঘোর বিরোধী। তারা উন্নয়ন সহযোগী। আমরা ঋণ নিয়ে থাকি এবং সুদ–আসলে পরিশোধ করি।’

অর্থ পাচার নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘হুন্ডির সঙ্গে পারি না। আর রিজার্ভ নিয়ে বাড়াবাড়ি করি না। রিজার্ভ বাড়বে-কমবে, এটাই স্বাভাবিক। সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, বড় অফিসারের বড় গাড়ি, বড় বাড়ি—এসব জায়গায় এখন বদল আনতে হবে।’

সংলাপে আরও বক্তব্য দেন আরেক বিশেষ অতিথি সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল, বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।