সরকারি দর কার্যকর হয়নি, উল্টো সরবরাহে টান

অভিযানের আতঙ্ক ও লোকসানের ভয়ে খুচরা বিক্রেতারা নতুন করে দোকানে আলু ও পেঁয়াজ তুলতে চাইছেন না।

এক সপ্তাহ আগে সরকার আলু, দেশি পেঁয়াজ ও ডিম—এই তিন পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজারে অভিযান শুরু করে। তবে পণ্যের দাম না কমে বরং বাজারে আলু ও দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কমতে শুরু করেছে। খুচরা বিক্রেতারা বলেছেন, অভিযানের আতঙ্ক ও লোকসানের ভয়ে তাঁরা নতুন করে দোকানে আলু ও পেঁয়াজ তুলতে চাইছেন না। পাইকারি বাজারেও আলু ও দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কমছে।

এই তিন পণ্যের বাইরে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), ভোজ্যতেল ও চিনির দাম সরকার আগে বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু সেসব পণ্যও সরকার নির্ধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে না।

গতকাল বুধবার রাজধানীর মালিবাগ, রামপুরা, কারওয়ান বাজার, আগারগাঁও তালতলা ও মোহাম্মদপুর টাউন হল—এই পাঁচটি বাজারে ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুচরা বিক্রেতারা এখনো পাইকারি বাজার থেকে কম দামে আলু, পেঁয়াজ ও ডিম কিনতে পারছেন না। তাই খুচরা বিক্রেতাদের অনেকে এসব পণ্য বিক্রিই বন্ধ রেখেছেন। দোকানে আলু ও দেশি পেঁয়াজ ওঠাচ্ছেন না তাঁরা। অনেক ক্রেতার ভরসা এখন আমদানি করা পেঁয়াজ।

এসব বাজারে গতকাল মানভেদে আলু বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজিতে। আর দেশি পেঁয়াজের দাম রাখা হয় প্রতি কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা। আলুর দাম প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা ও পেঁয়াজের ৬৪ থেকে ৬৫ টাকায় বেঁধে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে তিন পণ্যের মধ্যে নির্ধারিত দামের কাছাকাছি আছে কেবল ডিম। সরকার নির্ধারিত ১৪৪ টাকার বিপরীতে ডিমের ডজন কোনো কোনো বাজারে ওই দামে, আবার কোথাও ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজধানীর রায়েরবাজার সাদেক খান কৃষি মার্কেটে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান। গতকাল দুপুরে
ছবি: সাজিদ হোসেন

রামপুরা বাজারের মহিউদ্দিন স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি না করলে আমাদের খুব বেশি ক্ষতি নেই। কিন্তু সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি করতে হলে লোকসান দিতে হবে। অন্যদিকে সরবরাহ কম থাকায় পাইকারি বাজারে আলু ও দেশি পেঁয়াজের দামও সেভাবে কমছে না।’

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বাজারে অভিযানে গেলে তখন দাম কিছুটা কমে। তবে সেটা হয় ক্ষণস্থায়ী। রাজধানীর পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেছেন তাঁরা লোকসানের আশঙ্কায় মালামাল কম কিনছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি আলু বিক্রেতা মো. রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, হিমাগার থেকে সরাসরি আলু আসা কমেছে। তবে তাঁর কাছে এখনো যে আলু আছে, তা তিনি কয়েক দিন বিক্রি করতে পারবেন। তাঁর আশা, বড় কোনো সংকট হবে না এবং দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।

ঢাকায় আলুর বড় চালান আসে মুন্সিগঞ্জ থেকে। কিন্তু সেখান থেকে গত পাঁচ দিন সীমিত পরিমাণে আলু এসেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, হিমাগার থেকে আলু বাজারে ছাড়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাপ আছে। আবার হিমাগার থেকে ছাড়া আলুর দাম নিয়েও চলছে লুকোচুরি।

মুন্সিগঞ্জের রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে জানান, হিমাগার থেকে সাড়ে পাঁচ শ বস্তা আলু বিক্রি করা হয়েছে। তবে কত দামে এই আলু বিক্রি হয়েছে, তা বলা নিষেধ।

দেশি পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও চিত্র প্রায় একই। পাবনায় প্রচুর পেঁয়াজ হয়। জেলার সাঁথিয়া উপজেলার বোয়ালমারী বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী রাজা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়ী ও কৃষকের মধ্যে আতঙ্কের কারণে পেঁয়াজের বেচাকেনা কমেছে। কৃষকেরা পেঁয়াজ বের করছেন না। ঢাকার মতো বড় বাজারে সাহস করে পেঁয়াজ পাঠাতে পারছি না। কারণ, দাম নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি।’

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগে বোয়ালমারী বাজার থেকে প্রতিদিন তিন থেকে চার ট্রাক পেঁয়াজ ঢাকায় যেত। এক সপ্তাহ ধরে দুই ট্রাকের বেশি চালান ঢাকায় যাচ্ছে না।

তবে সমস্যা যে কেবল এই তিন পণ্য নিয়ে, তা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারনির্ধারিত দামে ভোজ্যতেল, চিনি ও রান্নার এলপি গ্যাস বিক্রি হয় না। এর মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম সময়ে সময়ে কার্যকর হয়েছে। তবে সর্বশেষ লিটারপ্রতি সয়াবিন তেলের দাম ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করা হলেও নতুন তেল এখনো বাজারে আসেনি। এই দাম গত রোববার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।

অন্যদিকে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও খুচরায় হচ্ছে ১৪০ টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতি মাসে এলপিজির দাম ঠিক করে দেয়। ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের নির্ধারিত দাম ১ হাজার ২৮৪ টাকা হলেও তা কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়।

মোহাম্মদপুরের মা স্যানিটারি অ্যান্ড হার্ডওয়্যারের মালিক মো. নুরুন্নবী জানান, কোম্পানিগুলো যে দামে গ্যাস দেয়, তাতে সরকারনির্ধারিত দরে সিলিন্ডার বিক্রি করা সম্ভব নয়। আবার কোম্পানিগুলো কোনো রসিদও (মেমো) দেয় না।

রাজধানীর আগারগাঁও তালতলা বাজারে গতকাল সকালে বাজার করার সময় গৃহিণী সাবরিনা আলম বলেন, ‘খবরে পড়েছি সরকার দাম কমিয়েছে। কিন্তু বাজারে এসে কম পেলাম না। তাহলে এভাবে ঘোষণা দিয়ে কী লাভ।’

সরবরাহে ঘাটতি চট্টগ্রামের বাজারেও

গতকাল চট্টগ্রাম নগরের খুচরা পর্যায়ের পাঁচটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না আলু, চিনি ও দেশি পেঁয়াজ। বাজারে আলু ও দেশি পেঁয়াজের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের সব বাজারে নতুন দামে পাওয়া যাচ্ছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল।

চট্টগ্রামের খুচরা পর্যায়ের অধিকাংশ বাজারে আলুর সরবরাহ করা হয় রেয়াজউদ্দিন বাজার আড়তগুলো থেকে। কিছু আলু সরবরাহ হয় চাক্তাই এলাকার মধ্যম চাক্তাই বাজার থেকে। এই দুই বাজারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার-পাঁচ দিন ধরে মুন্সিগঞ্জ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলু আসেনি।

অল্প পরিমাণে আলু মধ্যম চাক্তাই বাজারে এলেও দাম বেশি উল্লেখ করে চাক্তাই শিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান খালেদ বলেন, আগে আলু আসত ১০ থেকে ১২ ট্রাক। বুধবার আলু নিয়ে মাত্র একটি ট্রাক বাজারে এসেছে।

এদিকে চট্টগ্রামের চার উপজেলায় থাকা চারটি হিমাগারেও নেই খাওয়ার আলু। জানা গেছে, এসব হিমাগারের আলু গত মাসেই শেষ হয়ে গেছে। ফলে চট্টগ্রামের বাজার পুরোপুরি অন্য জেলা থেকে আসা আলুর ওপর নির্ভরশীল। চট্টগ্রামের বেশির ভাগ বাজারগুলোয় দেশি পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও প্রতিনিধি, মুন্সিগঞ্জ ও বেড়া, পাবনা)