চোরাই পথে বিপুল পরিমাণে গরু আসছে, অভিযোগ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের

ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত খামারিদের একাংশছবি: সংগৃহীত

আসন্ন ঈদুল আজহা সামনে রেখে নানা কৌশলে ভারত ও মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে দেশে গরু-মহিষ আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি বলেছে, দেশের বেশ কয়েকটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর বেশি পরিমাণে প্রাণী ঢুকছে। কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এটি হচ্ছে, আবার কখনো প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে।

আজ শনিবার রাজধানীর তোপখানা রোডের সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য দেন ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এ কে এম নাজীব উল্লাহ ও আলী আজম রহমান শিবলী, অর্থ সম্পাদক জাফর আহমেদ পাটোয়ারীসহ বিভিন্ন খামার মালিকেরা।

সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ২০১৪ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। এতে বাংলাদেশে গবাদিপশুর লালন–পালন বৃদ্ধি পায়। দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশ এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। কোরবানির ঈদের সময় প্রতিবছর দেশে ২০ লাখের বেশি গবাদিপশু উদ্বৃত্ত থাকে।

চলতি বছরেও চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ বেশি পশু প্রস্তুত রয়েছে। তারপরও ঈদুল আজহার আগে নানা কৌশলে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে দেশে গরু-মহিষ ঢুকছে।

চোরাই পথে আসা এসব পশু বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় হাট বসিয়ে প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মোহাম্মদ ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, এসব সীমান্ত হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে এসব পশু। এভাবে গরু আসায় বড় লোকসানের আশঙ্কা করছেন দেশের খামারিরা। এসব বিদেশি পশুর সঙ্গে নানা ধরনের রোগবালাই ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেও ব্যবসায়ীদের শঙ্কা। এ অবস্থায় সীমান্ত পথে গরু আসা বন্ধে কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়েছেন খামারিরা।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত কুমিল্লার মীনা অ্যাগ্রো খামারের মালিক মো. সজীব জানান, গত কয়েক দিন তিনি কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত হাট ঘুরেছেন। এ সময় প্রায় সব হাটেই বিপুল পরিমাণে বিদেশি গরু বিক্রি হতে দেখেছেন তিনি। মো. সজীব বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের যোগসাজশে চোরাই গরু আনা হচ্ছে। বর্তমানে সীমান্ত এলাকার হাটগুলো চোরাই গরু দিয়ে ভরে গেছে। এ অবস্থায় কোরবানি মৌসুমের ব্যবসা নিয়ে আতঙ্কে আছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ঝড়ের ক্ষতি কাটাতে সহায়তা দাবি

ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন জানান, সম্প্রতি বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের বড় ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে কোরবানির হাটের উদ্দেশ্যে যাঁরা গবাদিপশু লালন করেছেন, তাঁরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ১৯ জেলার ১০৭টি উপজেলার গবাদিপশু আক্রান্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন মোহাম্মদ ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, এতে অন্তত ২৫ লাখ গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে এখন মৃত্যুর খবর আসছে; এ ছাড়া প্লাবিত হয়েছে গবাদিপশুর ৯ হাজার ৭৫৯ একর চারণভূমি।

ফলে প্রাকৃতিক খাবারের বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা, গরুর গোয়াল নির্মাণ, পশুখাদ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি ও খামারিদের ক্ষতি নিরূপণ করে আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

মোহাম্মদ ইমরান হোসেন আরও বলেন, অনেক দুর্গত এলাকায় পশুর প্রয়োজনীয় খাবার এখন দুর্লভ।

অনাহারে কিংবা পচা খাদ্য খেয়ে অনেক পশু নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে; মারাও পড়ছে। চারণভূমিতে নতুন করে ঘাস তৈরি হতে আরও মাসখানেক সময় লাগতে পারে। এ অবস্থায় সরকার আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে খামারিদের জন্য কম দামে সাইলেজজাতীয় খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে।

বাল্ক ফিড মিল্ক আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির দাবি

সংবাদ সম্মেলনে ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে জানানো হয়, দেশে বর্তমানে বার্ষিক দুধের চাহিদা ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এর বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি ৪০ লাখ ৬৮ হাজার টন। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দুধের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এর পেছনে অন্যতম প্রধান বাধা আমদানি করা বাল্ক ফিড মিল্কজাতীয় গুঁড়া দুধ।

মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, দেশে শিশুখাদ্য হিসেবে পরিচিত কোনো ধরনের ফরমুলা মিল্ক তৈরি হয় না; এসব আমদানি করতে হয়। এটি শিশুদের জন্য আবশ্যকীয় পণ্য। ফরমুলা মিল্কে আমদানি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। কিন্তু বলেন, বস্তায় করে নিয়ে আসা ভেজিটেবল ফ্যাটযুক্ত ও স্বল্পমেয়াদি বাল্ক ফিড মিল্ক আমাদানিতে দেশে দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে। এসব দুধের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। দেশীয় দুগ্ধ শিল্প বাঁচাতে আসন্ন বাজেটে বাল্ক ফিড মিল্কজাতীয় গুঁড়া দুধ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। এ ছাড়া পশুখাদ্যের দাম কমানোর দাবি জানান তিনি।

অধিদপ্তরের সহযোগিতা না পাওয়ার দাবি

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদপুরের হাসিনা ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী রাশিদা বেগম। তিনি বলেন, সম্প্রতি তাঁর খামারের ২০টি গরুর মধ্যে ১৫টি গরু অজানা কারণে মারা গেছে। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের সহযোগিতা চেয়েও ঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। রাশিদা বেগম বলেন, চিকিৎসকেরা আসার আগেই চুক্তি করে নেন; কমপক্ষে ৮-১০ হাজার টাকা না দিলে তাঁরা আসতে চান না। একই ধরনের অভিযোগ করেছেন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আরও কয়েকজন খামারি।

এ বিষয়ে ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা খামারিবান্ধব আচরণ করছেন না। তাঁদের সেবার মানে তেমন উন্নতি না হলেও ভিজিটের অনেক উন্নতি হয়েছে।