সিকম ও সামুদা গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে সয়াবিন বীজ মাড়াই করে প্রাণিখাদ্য ও সয়াবিন তেল উৎপাদন করা হয়। গ্যাস-সংযোগ না পেয়ে দীর্ঘদিন এই কারখানা চালু করা যায়নি। পরে অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থায় এটি চালু হয়। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল ‘সয়াবিন দানা’ আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। তাতে পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না ওই কারখানা। 

সিকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, তাঁদের কারখানার জন্য এক জাহাজ সয়াবিন বীজ আমদানি করতে অন্তত ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণপত্র খোলা দরকার। ব্যাংকে ডলার-সংকটের কারণে ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। ডলারের বিনিময়মূল্যের অস্থিরতাও কমেনি। এতে কারখানাটির সক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে। 

মূল্যস্ফীতি, ডলার-সংকট ও গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যায় এক বছরের বেশি সময় ধরে চাপে রয়েছে দেশের বিভিন্ন শিল্প উৎপাদন খাত। নারায়ণগঞ্জে ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ এমনই একটি। 

আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সংকটগুলো সাময়িক বলা হলেও এখন মনে হচ্ছে সামনে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনো ঠিক হয়নি। সেই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। এসব কারণে একদিকে বিভিন্ন শিল্প খাতে চলমান বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমেছে, অন্যদিকে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারাও নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। 

নির্মাণকাজ দীর্ঘায়িত, কমছে উৎপাদন

মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস ফেব্রিকস তৈরির কারখানা স্থাপনে ৭০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে পলমল গ্রুপের। গত বছর সেখানে কারখানার নির্মাণকাজ শুরু করে তারা। এখন পর্যন্ত নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। 

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক মন্থর অর্থনীতির কারণে তাঁরা কারখানার নির্মাণকাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন। পলমলের অ্যাকাউন্টস, ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক (জিএম) কাজী আবদুল মুহিত বলেন, ‘আমাদের প্রধান রপ্তানিবাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে মূল্যস্ফীতির কারণে ফেব্রিকস পণ্যের চাহিদা প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। এ জন্য নতুন কারখানার নির্মাণকাজেরও গতি কমিয়ে দিয়েছি আমরা।’ 

অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পলমলের যেসব পোশাক কারখানা উৎপাদনে রয়েছে, সেগুলোর আয়ও কমেছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। 

একাধিক বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলার-সংকটের কারণে অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজের গতিও কমে গেছে। পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সুবিধার অভাবে বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বিনিয়োগও কমে গেছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেঘনা গ্রুপের এক কর্মকর্তা বলেন, বেশ কয়েক মাস ধরে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ওঠানামা করছে। এ কারণে নতুন বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। 

শুধু ডেলটা, মেঘনা বা পলমলই নয়, একই অবস্থা দেশের বেশির ভাগ শিল্পগ্রুপের। পোশাক, প্যাকেজিং, খাদ্য ও পানীয় খাতে দেশবন্ধু গ্রুপের কয়েক শ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। তবে গত এক বছরে গ্রুপটির বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি ৩১ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ঘটনাও ঘটেছে। মূলত ডলার-সংকট ও গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এমনটা হয়েছে। 

দেশবন্ধু গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘বছরখানেক হলো আমাদের শতভাগ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে ঋণপত্র খুলে বিভিন্ন কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়ে গেছে অনেক।’

জিডিপিতে বিনিয়োগ কমছে 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশে। অর্থাৎ পাঁচ বছরেও প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। 

গত এক বছরের ব্যবধানে প্রকৃত জিডিপিতে দেশের শিল্প উৎপাদন খাতের অবদানও কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) জিডিপিতে শিল্প উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ। 

বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা 

সম্প্রতি বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করেছে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন বা জেট্রো। জরিপে বাংলাদেশে ব্যবসারত জাপানি কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রায় ৭১ শতাংশই জানিয়েছে, এখানকার ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নয়। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে এ দেশে বিনিয়োগ রয়েছে জাপানের উদ্যোক্তাদের। 

এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বিএসইজেড) বা জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা বলা যায়। সেখানে শিল্প স্থাপনের জন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠান জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু করেছে মাত্র একটি কোম্পানি। এ বিষয়ে বিএসইজেড কর্তৃপক্ষের কেউ সরাসরি কথা বলতে চাননি। তবে জাপানি বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন জেট্রোর এ দেশীয় প্রতিনিধি ইউজি আন্দো বলেন, প্রায় সব দেশেই নির্বাচনী বছরে বিনিয়োগকারীরা ‘ধীরে চলো নীতি’ অনুসরণ করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেটি হচ্ছে।

আগ্রহ কমাচ্ছে যেসব বিষয় 

জেট্রোর জরিপে বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার উদ্বেগ ছাড়াও দেশের শুল্কায়ন ব্যবস্থার জটিলতা, ডলারের দামের অস্থিরতা, দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি, মজুরি বৃদ্ধি, স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল কেনার জটিলতা, বিদ্যুতের সমস্যা ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা। 

দেশে গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এটি গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে গত মাস পর্যন্ত ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল ১০৯ টাকা, যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ৮৫ টাকার আশপাশে। ডলারের এ মূল্যবৃদ্ধিতে পণ্য ও কাঁচামাল আমদানি খরচও বেড়ে গেছে। আবার চাহিদা অনুযায়ী, ঋণপত্র খুলতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে কমে গেছে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ের তুলনায় ২০২২-২৩ সালে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলার পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ কমেছে।

সরকার চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। সার ও চা শিল্প ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে গ্যাসের প্রতি ইউনিটের দাম বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। শিল্পভেদে এই দাম বেড়েছে ৮৭ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও বেড়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এসব কারণে শিল্পকারখানায় পণ্য উৎপাদন বা নতুন শিল্প স্থাপনে খরচ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এ কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। 

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কিছু নীতিগত সমস্যা তো দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। তার সঙ্গে বর্তমানে ডলার-সংকটের মতো কিছু বিষয় নতুন করে যোগ হয়েছে; যার প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগ ও পণ্য উৎপাদনে। এসব কারণে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আর যাঁদের আগ্রহ রয়েছে, তাঁরাও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সময় নিচ্ছেন।