বছরে নগদের লোকসান ১২৫ কোটি, বন্ড ছেড়ে ৫১০ কোটি টাকা তোলার অনুমতি

মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’

মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ বছরে গড়ে ১২৫ কোটি টাকা লোকসান করছে। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৬২ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৬১৮ কোটি টাকা। এই অবস্থায় ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করা নগদকে দেশের পুঁজিবাজারে বন্ড ছেড়ে ৫১০ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

পুঁজিবাজার থেকে নগদ যে টাকা তুলবে, তা থেকে ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবে। বাকি ১১০ কোটি টাকা ব্যবহার করবে চলতি মূলধন হিসেবে।

নগদের এই বন্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর। এর বার্ষিক সুদহার হবে প্রায় ১০ শতাংশ। তবে নিয়মিত সুদ পরিশোধ করতে না পারলে ২ শতাংশ জরিমানা গুনতে হবে। বিএসইসিতে নগদের জমা দেওয়া প্রসপেক্টাস বা বিবরণপত্রে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

বিবরণপত্র অনুযায়ী নগদ আগামী ২০২৪ সালেও লোকসানের আশঙ্কা করছে, যা পরিমাণে পাঁচ কোটি টাকা। তবে এরপর থেকেই মুনাফায় ফেরার আশা প্রতিষ্ঠানটির। ২০২৫ সালে ২৮ কোটি টাকা, ২০২৬ সালে ৬৪ কোটি টাকা, ২০২৭ সালে ১১৪ কোটি টাকা এবং ২০২৮ সালে ১৭১ কোটি টাকা মুনাফা অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছে।

প্রসপেক্টাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, নগদের সেবাটি ডাক বিভাগের বলে প্রচার করা হলেও এর মালিকানায় ডাক বিভাগের কোনো অংশগ্রহণ নেই। এতে বলা হয়েছে, দেশের এমএফএস বাজারের ৪০ শতাংশ বিকাশের, ২৫ শতাংশ নগদের ও ১৮ শতাংশ রকেটের। দেশে ১৩টি এমএফএস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত বছরের জুন শেষে নগদের গ্রাহক ছিল ৬ কোটি ৪৭ লাখ। অবশ্য এর মধ্যে সক্রিয় গ্রাহক অর্ধেকের কম।

জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে নগদ মুনাফায় যাবে, এমন পূর্বাভাস দিয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ড ছেড়ে ৫১০ কোটি টাকা তোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বন্ড ছাড়ার বিধিবিধান পূরণ করায় এই অনুমোদন।’  

আরও পড়ুন

কেন লোকসানে নগদ

নগদের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আয় থেকে ব্যয় করে গ্রস প্রফিট বা মোট মুনাফা করলেও উচ্চ পরিচালন, প্রশাসনিক, বিপণন ও প্রচারে উচ্চ খরচের কারণে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে পড়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে গ্রস বা মোট মুনাফা ৯৫ কোটি টাকা হলেও পরিচালন ও প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে ১৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিপণন ও প্রচারের পেছনে খরচ হয়েছে ১২৪ কোটি টাকা। অন্যান্য আয়–ব্যয় মিলিয়ে বছর শেষে লোকসান হয় ১৮৭ কোটি টাকা।

একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে নগদ মোট ১০১ কোটি টাকা মুনাফা করলেও পরিচালন ও প্রশাসনিক খরচ হয় ২৯২ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিপণন ও প্রচারের পেছনে খরচ হয় ১৫৭ কোটি টাকা। বছর শেষে সার্বিকভাবে নগদের লোকসান দাঁড়ায় ২৬২ কোটি টাকা, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।

নগদ একই কারণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৩ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২৯ কোটি টাকা লোকসান দেয়। অবশ্য প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলোর জন্য লোকসানে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, এসব কোম্পানিতে ধারাবাহিক বিনিয়োগ ও উন্নয়ন প্রয়োজন হয়। তবে নগদের লোকসানের পরিমাণটা একটু বেশি।  

কেন বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ

ব্যবসা ও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন খাত থেকে ঋণ নেয় নগদ। ২০২১-২২ অর্থবছরের আর্থিক বিবরণী অনুসারে, ৬১৭ কোটি ৬০ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এমন পরিস্থিতিতে ৫১০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর অনুমতি চেয়েছে নগদ। এই বন্ডের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। বন্ড ছেড়ে তোলা টাকার মধ্যে ৪০০ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধে খরচ করা হবে। এর মধ্যে ১১০ কোটি টাকা শোধ করা হবে সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডকে। সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড হচ্ছে নগদের প্রায় ৪৩ শতাংশ অগ্রাধিকারভিত্তিক (প্রেফারেন্স) শেয়ার ও ৮ শতাংশ সাধারণ শেয়ারের মালিক। বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত বাকি ১১০ কোটি টাকা খরচ করা হবে চলতি মূলধন খাতে। চলতি মূলধন খাতের টাকা খরচ হবে সেবা পরিচালনায় পর্যাপ্ত তারল্যের জোগান হিসেবে ও দৈনন্দিন খরচের জন্য।

এদিকে প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক নগদের ৩১৭ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ ব্যাংকটিতে থাকা মেয়াদি আমানত দিয়ে সমন্বয় করে দিয়েছে। এ নিয়ে অবশ্য আদালতে মামলা চলমান আছে।

যোগাযোগ করা হলে নগদের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পুঁজিবাজারে বন্ড ছেড়ে ৫১০ কোটি টাকা তোলার অনুমোদন পেয়েছি বিএসইসির কাছ থেকে। এতে সুদ দেওয়া হবে প্রায় ১০ শতাংশ। এই টাকা নগদের বিপণন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ঋণ পরিশোধে খরচ করা হবে। এর মাধ্যমে নগদের সেবার মান আরও উন্নত করার চেষ্টা করা হবে।’  

আরও পড়ুন

নগদের মালিকানায় যারা

নগদের ৮ শতাংশ সাধারণ শেয়ার রয়েছে সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্সের কাছে, যেটির প্রতিনিধি সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল নগদের চেয়ারম্যান। তাসিয়া হোল্ডিং প্রায় ৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক, যার প্রতিনিধি তানভীর এ মিশুক নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২৮ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় থাকা স্টালওয়ার্ট লিমিটেডের প্রতিনিধি তামজীদ রহমান হলেন পরিচালক। এ ছাড়া ২২ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা ফিনক্লুশন ভেঞ্চারের, যেটির প্রতিনিধি ফায়সাল আহসান চৌধুরী, মারুফুল ইসলাম ঝলক ও মোহাম্মদ আমিনুল হক নগদের পরিচালক। এ ছাড়া শেয়ার নিয়ে পরিচালক হিসেবে আছেন মিয়ার্স হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধি গিলনস এলস্টায়ার জেমস ফার্লে, ব্লু ওয়াটার হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধি সাফায়েত আলম ও ফিনটেক হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধি নিয়াজ মোর্শেদ। গত বছরের ২৫ জুলাই পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন রাহেল আহমেদ, তিনি ফিনক্লুশন ভেঞ্চারের প্রতিনিধি ছিলেন।

নগদ বাংলাদেশের এমএফএস বাজারে দ্রুত বর্ধনশীল সেবাগুলোর একটি। মোবাইল ফোনে হিসাব খোলার সুযোগ ও কম খরচের কারণে সেবাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।