বেসরকারি বিনিয়োগে সুখবর কম

অর্থনীতিতে এখন যে কয়টি বড় চিন্তার বিষয় রয়েছে, বেসরকারি বিনিয়োগ এর অন্যতম।

ডলার–সংকটে শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে। পাশাপাশি জ্বালানি–সংকটেও ভুগছে শিল্পকারখানা। তাতে কমেছে উৎপাদন। ক্রয়াদেশের অভাবে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে পণ্য রপ্তানিও দেড় শতাংশ কমছে। অন্যদিকে সুদহার কম থাকার পরও বেসরকারি বিনিয়োগেও নেই বড় কোনো সুখবর।

দেশে বিনিয়োগ একেবারেই বাড়ছে না, তা নয়। তবে এ ক্ষেত্রে যে গতি দরকার, সেটা নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগ দাঁড়াবে ১৩ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, এটি গত বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ১০ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিনিয়োগকে দেখা হয় জিডিপির অনুপাতে। দেশে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার এখন ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। সাত বছর ধরেই বেসরকারি বিনিয়োগ প্রায় স্থবির হয়ে আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিতে এখন যে কয়টা বড় চিন্তার বিষয় রয়েছে, তার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ অন্যতম। বর্তমান পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি থমকে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপও কমবে না।

এমন এক প্রেক্ষাপটেই আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামী বাজেট করা হচ্ছে ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার। বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং বিনিয়োগ বাড়ানোই হবে অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থেকেই

অনেক ধরনের সমস্যা চলছে। যেমন বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয় কিংবা উপযুক্ত জমি পাওয়া যায় না। সরকার এর জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল ও এক দরজায় সেবা (ওএসএস) চালু করেছে। এগুলো এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন ও কার্যকর হয়নি। অর্থাৎ বিনিয়োগে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কোনো উদ্যোগই চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়নি। এর সঙ্গে ডলার–সংকট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি বিষফোড়া হিসেবে যুক্ত হয়েছে।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ডলার–সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি রয়েছে। ফলে অনেক জটিলতা থাকা সত্ত্বেও যতখানি বিনিয়োগ হওয়ার কথা সেটাও আসেনি।

ডলার–সংকটের কারণেই বর্তমানের এই জ্বালানি–সংকট। দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ গ্রহণের সীমাও ৩ কোটি ডলার থেকে ২ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী

বিনিয়োগ কেন কম

বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের বলার মতো কোনো উন্নতি হয়নি, বরং গত এক বছরে তিনটি সূচকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এমন চিত্রই উঠে এসেছে বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২২-২৩ জরিপে। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত জরিপের তথ্যানুযায়ী, ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পাওয়া জটিল আকার ধারণ করেছে। কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি আগের চেয়ে বেড়েছে। আবার কারখানা বা ব্যবসার জন্য জমি পাওয়াটাও আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে।

বিবিএক্স জরিপটি করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ। জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে জ্বালানি–সংকটে দেশীয় শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহী হচ্ছেন। এ সমস্যা সমাধানে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।

দেশের করব্যবস্থা নিয়ে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগকারীর অনেক অভিযোগ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, কয়েক দফায় কমানোর পরও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সার্বিক করের পরিমাণ অনেক বেশি। আগামী বাজেটে কর আরও কমানো দরকার। এ ছাড়া ভ্যাটের একাধিক হার কমিয়ে আনার পাশাপাশি এই ব্যবস্থাকে আরও সহজ করা হলে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

অর্থনীতিবিদদের মত হচ্ছে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ পেলে ওই ব্যক্তিকে বেকার ধরা হবে না, এই সংজ্ঞা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই অর্থবহ নয়। এগুলো শিল্পোন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য।

বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে ২৯০ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল। আর গত বছর আসে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ। তার মানে গত বছর ৫৫ কোটি ডলারের এফডিআই বেশি এসেছে। তবে মূলধন বা নতুন বিনিয়োগ কমেছে, বেড়েছে পুনর্বিনিয়োগ।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ডলার–সংকটের কারণে অনেক কোম্পানি নিজ দেশে মুনাফা নিতে পারেনি। এ কারণে কাগজে-কলমে পুনর্বিনিয়োগ বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এই অর্থের পুরোটা বিনিয়োগ হয়েছে, তা বলা যাবে না।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এফডিআই জিডিপির ৩-৪ শতাংশ করার কথা ছিল। জিডিপির ৩ শতাংশ ধরলেও প্রায় ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই আসা উচিত ছিল। সেখানে আমাদের বর্তমান অবস্থান খুবই নগণ্য। সার্বিকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো না। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল ২৮ শতাংশ। তবে সেই জায়গায় পৌঁছানো যায়নি।

এমন তথ্য দিয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবার আগে রিটার্ন নিয়ে চিন্তা করেন। যখন তাঁরা দেখেন পদ্ধতিগত কিছু সমস্যার কারণে ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটে, তখন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ করতে চান না। তিনি আরও বলেন, গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময়েও জাপানিরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে তারা বলেছে, বাংলাদেশে ব্যবসায় সমস্যা আছে। সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান না করে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে।

আইএলওর সংজ্ঞা বলছে, ৩০ দিন ধরে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি সর্বশেষ সাত দিনে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাঁকে বেকার হিসেবে ধরা হবে।

উৎপাদন কমেছে, সঙ্গে কর্মসংস্থানও

জ্বালানি–সংকট ও পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বস্ত্র, তৈরি পোশাক, সিরামিক, ইস্পাতসহ বিভিন্ন খাতের শিল্পকারখানার উৎপাদন কমেছে। তার মধ্যে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকে নতুন নিয়োগ বন্ধ। কোনো কোনো কারখানা কর্মী ছাঁটাইও করছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আদেশ কমেছে। ফলে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ৮৩৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দেড় শতাংশ কম। সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাক থেকে এসেছে। বর্তমানে এ খাতের প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক ৭৭ শতাংশ।

জানতে চাইলে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী গত রোববার প্রথম আলো বলেন, সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসার পরিবেশ বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে নেই। জ্বালানি–সংকটের কারণে বস্ত্র খাতের কারখানাগুলো ৫০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে। নতুন নিয়োগ বন্ধ। জ্বালানি–সংকট ও ক্রয়াদেশ না থাকায় গত চার মাসে নিজের প্রতিষ্ঠানের ৪০০ কর্মী বাদ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, ‘ডলার–সংকটের কারণেই বর্তমানের এই জ্বালানি–সংকট। দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ গ্রহণের সীমাও ৩ কোটি ডলার থেকে ২ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। শিগগিরই ব্যাংকঋণের সুদের হার দুই অঙ্কের ঘরে যাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন বিনিয়োগ তো দূরে, যাঁরা ব্যবসায় আছেন, তাঁদের টিকে থাকতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

এদিকে দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গত মাসে প্রকাশিত জরিপের তথ্যানুযায়ী, বেকারদের মধ্যে ১৬ লাখ ৯০ হাজার পুরুষ এবং ৯ লাখ ৪০ হাজার নারী।

বেকার সংখ্যার হিসাবটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী করে বিবিএস। আইএলওর সংজ্ঞা বলছে, ৩০ দিন ধরে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি সর্বশেষ সাত দিনে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাঁকে বেকার হিসেবে ধরা হবে। যদিও অর্থনীতিবিদদের মত হচ্ছে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ পেলে ওই ব্যক্তিকে বেকার ধরা হবে না, এই সংজ্ঞা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই অর্থবহ নয়। এগুলো শিল্পোন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সব দোষ যুদ্ধের ওপর চাপানোর সময়টা পার হয়ে গেছে। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশই অসুবিধায় পড়েনি। অন্যান্য দেশে এখন মূল্যস্ফীতি কমছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারছে না। এ জন্য সমস্যার মূল কারণগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্রুত সেগুলো সমাধান করতে হবে। যুদ্ধের ওপর দায় চাপানোর কৌশল থেকে বের হয়ে আসতে হবে।