পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক সাকিব আজিজ চৌধুরী সম্প্রতি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তাঁর পদত্যাগপত্র ঝুলে আছে এবং কোম্পানির ওয়েবসাইটে এখনো তাঁর নাম ও ছবি আছে।
তাঁর বদলে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে মনোনীত হয়েছেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (এআইইউবি) অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক খন্দকার সাব্বির মোহাম্মদ কবির।
সাকিব আজিজ চৌধুরীর পদত্যাগের কথা জানিয়ে ডেল্টা লাইফের চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার ১৯ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি পাঠিয়েছেন। এ চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ)।
সাকিব আজিজ চৌধুরী সরকারের একজন মন্ত্রীর পরিবারের আত্মীয়।
জানা গেছে, সাকিব আজিজ চৌধুরী পদত্যাগ করলেও ডেল্টা লাইফ কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করতে শুরুতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কোম্পানির ২৫৪তম পর্ষদ সভায় এ ব্যাপারে দুজন আইনবিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আইনি মতামত পদত্যাগপত্র গ্রহণের পক্ষে আসে। এরপর ২৫৫তম পর্ষদ বৈঠকে খন্দকার সাব্বির মোহাম্মদ কবিরকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।
পদত্যাগপত্র গ্রহণে ডেল্টা লাইফ কর্তৃপক্ষ কেন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তা ওঠে আসে হাফিজ আহমেদ মজুমদারের চিঠিতেই। চিঠিতে বলা হয়, স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে সাকিব আজিজ চৌধুরী ডেল্টা লাইফের নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর অনুপস্থিতিতে নিরীক্ষা কমিটির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। নিরীক্ষা কমিটির বৈঠক না হলে আগামী বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করা যাবে না। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া গত ৩১ জানুয়ারির রায়ে আগামী ৩১ মে তারিখের মধ্যে ডেল্টা লাইফকে এজিএম করতে হবে।
ডেল্টা লাইফের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্দেশনায় এবং পরে আইডিআরএর সঙ্গে হওয়া সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী গঠিত। এ পর্ষদকে পরে অনুমোদন করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
পরিচালক জেয়াদ রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাকিব আজিজ চৌধুরীর পরিবর্তে নতুন কাউকে নিয়োগ দিতে হলে বিএসইসি, আইডিআরএ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদন লাগবে। আমরা সে অপেক্ষায় আছি।’
আট সদস্যের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। সাকিব আজিজ চৌধুরীর মতো কোম্পানির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারও স্বতন্ত্র পরিচালক। আর ভাইস চেয়ারম্যান হলেন জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের পরিচালক অধ্যাপক মো. জুনায়েদ শফিক।
অন্যদের মধ্যে একই পরিবার থেকে পরিচালক আছেন ডেল্টা লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের স্ত্রী সুরাইয়া রহমান, তাঁদের মেয়ে আদিবা রহমান ও ছেলে জেয়াদ রহমান। আদিবা রহমান কোম্পানিটির সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।
এ ছাড়া হা-মীম গ্রুপের কর্ণধার এ কে আজাদের ছেলে দ্যাটস ইট স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে সাকিব আজাদ এবং আরকম অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে চাকলাদার রেজানুল আলম ডেল্টা লাইফের পরিচালক।
গত ২৪ জুলাই আইডিআরএ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সমঝোতার মধ্য দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর গত ২২ আগস্ট পর্ষদ গঠনের সমঝোতা চুক্তি অনুমোদন দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির পর্ষদ স্থগিত করে প্রশাসক বসায় আইডিআরএ। ফাঁকে প্রশাসক বদল হয় তিনবার। প্রথমবার প্রশাসক ছিলেন আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য সুলতান উল আবেদীন মোল্লা, দ্বিতীয় প্রশাসক সাবেক যুগ্ম সচিব মো. রফিকুল ইসলাম ও তৃতীয় প্রশাসক কুদ্দুস খান।
এর মধ্যে প্রশাসক মো. কুদ্দুস খানকে আইডিআরএ জানিয়ে দেয়, গত ২২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিমা আইন অনুযায়ী তাঁকে ডেল্টা লাইফের প্রশাসকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
৯ শর্তে বর্তমান পর্ষদ
নতুন পর্ষদ গঠনে ডেল্টা লাইফকে নয়টি শর্ত দিয়েছিল আইডিআরএ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এজিএম করা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিবের নিচে নয়—এমন একজন কর্মকর্তা পর্যবেক্ষক থাকা, কোম্পানির আর্থিক বিবরণী-সম্পর্কিত তথ্য উদ্ঘাটনে নতুন করে নিরীক্ষা করা, আগে নিরীক্ষিত বিষয়গুলো শুনানি সাপেক্ষে নিষ্পত্তি করা, পুনর্গঠিত পর্ষদকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এক বছরের ব্যবসায়িক কৌশলপত্র দাখিল করা, কৌশলপত্রের অগ্রগতি এক মাস পরপর আইডিআরএকে জানানো, বিমা আইন ও বিধিনিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করে শিগগির একজন দক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য সিইও নিয়োগ করা, আগে কোনো অনিয়ম চিহ্নিত হয়ে থাকলে তার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং আইডিআরএ আগে যেসব জরিমানা আরোপ করেছে, সেগুলো আইন অনুযায়ী বিবেচনা করা।
জানা গেছে, সব শর্ত পূরণ করলেও ডেল্টা লাইফ এখনো প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও নিয়োগ দেয়নি। আনোয়ারুল হক নামের এক কর্মকর্তা চলতি দায়িত্বে সিইও হিসেবে কাজ করছেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে এর আগে পাঠানো এক আবেদনে ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দীর্ঘ দিন প্রশাসক থাকায় কোম্পানির স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না, পলিসি হোল্ডারদের সঠিক হারে বোনাস দেওয়া যাচ্ছে না এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।