কেমন ছিল ২০০৮ সালে, এবারই-বা কেমন

সিগনেচার ও সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ধসের একটি ২০০৭-০৮ সালে সংঘটিত হয়। তবে অনেক বিশ্লেষক বলেন, এটা ছিল আর্থিক খাতের ধস, ঠিক অর্থনৈতিক ধস নয়।

যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বব্যাপী এ বিপর্যয়ের সূতিকাগার। সেবার শেয়ারবাজারের রেকর্ড দরপতন ঘটে। বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান বন্ধের জেরে মার্কিন সরকার প্রায় এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি ডলারের বেইলআউট প্যাকেজ ঘোষণা করে, যদিও সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় দুই ট্রিলিয়ন বা দুই লাখ কোটি ডলার।

অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, এবার যে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেল, তা কি ২০০৭–০৮ সালের মতো আরেকটি বড় ধসের সূচনা করল। তবে এ নিয়ে ভিন্ন মতও আছে। আরেক দল মনে করছে, এবারের সংকট অত বড় রূপ নেবে না। সে জন্য দেখে নেওয়া যাক, ২০০৭–০৮ সালের ধসের প্রকৃতি কেমন ছিল আর এবারের ধসেরই–বা কেমন।

বলা হয়ে থাকে, মার্কিন মুলুকে ১৯৩০–এর দশকে ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামের যে ভয়াবহ আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়, ভয়াবহতার দিক থেকে ২০০৮–এর বিশ্বব্যাপী এ সংকটের অবস্থান ঠিক তার পরেই।

২০০৭ সালের আগে আমেরিকার ব্যাংকগুলো বেশি বেশি সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় নামে। সে জন্য দেখা যায়, ঋণ নেওয়ার একেবারে অনুপযোগী ব্যক্তিদেরও দেদারে গৃহঋণ দেয় তারা। গ্রাহকেরা যে দেউলিয়া হতে পারেন, সে বিষয়ে নিয়ে ব্যাংকগুলো তখন মোটেও চিন্তিত ছিল না । কারণ, ঋণের বিপরীতে কেনা বাড়িটি বন্ধক থাকত। কেউ দেউলিয়া হলেই ব্যাংক বাড়ির মালিক!

ঋণ দেওয়ার সময় ব্যাংক বাড়িটিকে বন্ধক রেখে তার বিপরীতে ঋণ দিয়েছিল। ব্যাংক যখন এ ঋণের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার মাধ্যমে ঋণটি বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দেবে, তখন ওই বাড়িটিই বন্ধকী (মর্টগেজড) সম্পদ (অ্যাসেট) হিসাবে গণ্য হবে। অ্যাসেট সিকিউরিটাইজেশন নানা ধরনের হতে পারে, মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটি এর একটা বিশেষ ধরনমাত্র। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যখন বন্ধকী স্থাবর সম্পত্তির বিপরীতে সিকিউরিটি ইস্যু করা হয়, তখন সেই সিকিউরিটিকে বলা হয় মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটি।

মর্টগেজ বা বন্ধকী সম্পদ আবার দুই ধরনের হতে পারে—প্রাইম ও সাব–প্রাইম মর্টগেজ। প্রাইম মর্টগেজ হচ্ছে সেই ধরনের সম্পদ, যেগুলো নিয়মিত বন্ধকী দেনা পরিশোধ করে যাচ্ছে। যদি ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করে দিতে পারে, তাহলে সেটা ব্যাংকের জন্য ভালো মানের (প্রাইম) বন্ধকী (মর্টগেজ) সম্পদ। আর যদি দেখা যায়, কোনো কারণে ঋণ ঠিক সময়ের মধ্যে পরিশোধিত হচ্ছে না, তাহলে সেটা ব্যাংকের জন্য নিম্নমানের (সাব–প্রাইম) বন্ধকী (মর্টগেজ) সম্পদ।
সে জন্য ২০০৮ সালের সংকট সাব–প্রাইম মর্টগেজ ক্রাইসিস হিসেবেও চিহ্নিত হয়।

এদিকে প্রতিবছর বাড়ির ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করুক কি দেউলিয়া হোক, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাংকের লাভ থাকত। এ লোভনীয় হিসাবের পাকেচক্রে ব্যাংক কাউকে ঋণবিমুখ করত না। একপর্যায়ে ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তিরাও বাড়ি কেনার সুযোগ পেতে থাকেন। ব্যাংকও খুব খুশি। কারণ, এটা লোকসানবিহীন ব্যবসা। গ্রাহকও খুশি। কারণ, যাঁদের কোনো দিন নতুন বাড়ি করার সামর্থ্য ছিল না, তাঁরাও বাড়ি পেয়ে গেলেন।

এ ধারা চলতে চলতে একপর্যায়ে সীমা অতিক্রম করে যায় এবং গ্রাহকেরা গণহারে দেউলিয়া হতে শুরু করেন। একসময় এত বেশি বাড়ির মালিক দেউলিয়া হয়ে পড়েন যে বিক্রির তালিকায় থাকা বাড়ির সংখ্যা ক্রেতাদের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় আরেকবারের মতো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাড়ির দাম পড়তে শুরু করে। বাড়ির দাম পতনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলোও লোকসানের সম্মুখীন হয়। ব্যাংকের পাশাপাশি বিমা কোম্পানিরও লোকসান শুরু হয়। কারণ, ব্যাংক ঋণগুলোর বিমা করা ছিল। এভাবে দেউলিয়াপনা মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং বেকারত্বও অনেক বেড়ে যায়। ফলে বাড়ির দাম এতটাই কমে যায় যে বাজার রীতিমতো দিশাহারা হয়ে যায়।

বিষয় হচ্ছে, ঘরবাড়ির দাম কমলে ঋণী ব্যক্তিরা স্বেচ্ছায় দেউলিয়া হতে থাকেন। কারণ, ১ কোটি টাকার ঋণে ঘর কেনা শেষেই ঘরের মূল্য যদি ৭০ লাখ টাকা হয়, অর্থাৎ কেউ যদি ১ কোটি টাকা দিয়ে ৭০ লাখের একটি বস্তু কিনে পরে ১ কোটি টাকার উপরে সুদ দেন, তাহলে ঘর বিক্রি করেও ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। তাই ভিত্তিহীন ঋণের খপ্পর থেকে বাঁচতে একমাত্র উপায় ছিল দেউলিয়া হয়ে যাওয়া।

ক্ষতির পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতেই সুবৃহৎ একটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়, যার নাম লেহম্যান ব্রাদার্স। বিভিন্ন ডেরাইভেটিভের কারণে তার এ পরিণতি হয়। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বেকারত্ব। নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল অনেক পরিবার, যারা এমনকি হারিয়েছিল মাথা গোঁজার শেষ ঠাঁই পর্যন্ত।

এবারের সংকট

চলতি মার্চ মাসে ২০০৮ সালের পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক বন্ধ হলো। তিন দিনের ব্যবধানে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেল। এ ঘটনায় পৃথিবীজুড়ে আর্থিক বাজারে রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে অস্বস্তিকর একটি প্রশ্ন—এ ঘটনা কি আরও ধ্বংস ডেকে এনে পুরো ব্যাংকিং খাতকে পতনের পথে নিয়ে যাবে?

সিএনএন এক বিশ্লেষণে বলেছে, শতকোটি ডলারের মালিক হেজফান্ড ব্যবস্থাপক বিল অকম্যান এসভিবির সঙ্গে বেয়ার স্টানর্সের তুলনা করেছেন। ২০০৭–০৮ সালে যে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট হয়েছিল, তার সূচনাতেই ধসে পড়েছিল এ ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান।

টুইটারে বিল অকম্যান লিখেছেন, একটি ব্যাংকের ব্যর্থতা এবং আমানত হারানোর ঝুঁকিটি হলো, এ ধরনের ঘটনা যদি কম সম্পদের ব্যাংকে এরপর ঘটে এবং সেটিতে যদি ধস নামে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা একের পর এক ঘটতে পারে।

তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষক এখন পর্যন্ত এটাই মনে করেন যে এসভিবির ঘটনা শুধু একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির ব্যাপার। এটি প্রযুক্তি স্টার্টআপকে ঋণ দিত। কিন্তু অর্থনীতির ধীরগতি এবং সুদের হার দ্রুত বাড়ার কারণে সিলিকন ভ্যালির তহবিল ফুরিয়ে যায় এবং এটি প্রচণ্ড চাপে পড়ে।

এবারের সংকটের কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বৃদ্ধি। এত দিন মূলত মূল্যস্ফীতির মধ্যেই এর প্রভাব সীমিত ছিল। বলা যায়, সামষ্টিক অর্থনীতিতে এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রভাব।
বিষয়টি হচ্ছে, গত বছরের শুরুতেই ফেডের নীতি সুদহার ছিল শূন্যের কাছাকাছি।

কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেনজনিত মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় গত এক বছরে ফেড আটবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে। ফলে বাণিজ্যিক ঋণের সুদহারও বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে সে দেশের বন্ডের সুদহার বেড়েছে। ঋণ ও বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ার সম্মিলিত ফল হলো, বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদ জায়গায় বিনিয়োগ করার সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়া। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা ভাবছেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রকল্পে বিনিয়োগ না করে, বরং বন্ডে বিনিয়োগ করাই ভালো, আরামে সুদ খাওয়া যাবে।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো। বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপে বিনিয়োগ কমিয়ে দেওয়ায় সিলিকন ভ্যালির এ স্টার্টআপগুলো সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে রক্ষিত আমানত ভেঙে খেতে শুরু করে। তাতে সিলিকন ভ্যালির ব্যাংকের আমানতে টান পড়ে। এ বাস্তবতায় এসভিবি গত বুধবার ২১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বন্ড বিক্রি করে, যার সিংহভাগই ছিল মার্কিন ট্রেজারি বন্ড। এর সুদহার ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ, অথচ ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার প্রায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। ফলে বন্ড বিক্রি মুখ থুবড়ে পড়ে। তাদের ক্ষতি হয় ১৮০ কোটি ডলার।

এরপর সেই ক্ষতি পোষাতে বৃহস্পতিবার এসভিবি ২২৫ কোটি ডলার সমমূল্যের ইকুইটি বিক্রির ঘোষণা দেয়। বলা যায়, এটা ছিল কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো। হুড়মুড়িয়ে আমানত তুলে নিতে শুরু করেন আমানতকারীরা। পতন হয় ৪০ বছরের পুরোনো এই ব্যাংকের।

সে জন্য বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এবারের সংকট ২০০৭–০৮ অর্থ বছরের মতো হবে না।