ব্যাংক হিসাব না থাকলেও সর্বজনীন পেনশনের গ্রাহক হওয়ার সুবিধা চালু

পেনশনপ্রতীকী ছবি

দেশে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালুর পর থেকে সরকার বলে আসছিল, এ কর্মসূচির আওতায় যেকোনো একটির গ্রাহক হতে হলে ব্যাংক হিসাব থাকা বাধ্যতামূলক। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সে জায়গা থেকে সরে এসেছে। ব্যাংক হিসাব থাকার বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে। ৪ মে এ বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে পেনশন কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, সর্বজনীন পেনশনের গ্রাহক হতে নিবন্ধনের জন্য এখন ব্যাংক হিসাব না থাকলেও চলবে। মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক হলেও পেনশন কর্মসূচির গ্রাহক হওয়া যাবে। 

তবে এমএফএসের মধ্যে আপাতত নগদের সঙ্গে পেনশন কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়েছে। বিকাশ বা অন্য এমএফএসের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তাই বর্তমানে কেউ যদি নগদের গ্রাহক হন, তাহলে তিনি পেনশন কর্মসূচির গ্রাহক হওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন এবং চাঁদা দিতে পারবেন। ব্যাংক হিসাব থাকলে ভালো, না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে গত শনিবার এসব তথ্য জানা গেছে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশনের আওতায় বিদ্যমান বিভিন্ন কর্মসূচিতে ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি গ্রাহক হয়েছেন। আর তাঁদের কাছ থেকে চাঁদা বাবদ জমা হয়েছে ৬০ কোটি টাকা।

কোনো পেনশন কর্মসূচির গ্রাহক হতে চাইলে আবেদন ফরমে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ব্যাংক হিসাব নম্বর উল্লেখের ঘর রয়েছে। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংক হিসাব নম্বরের ঘরে যুক্ত করা হয়েছে এমএফএস হিসাবের নম্বর। তবে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির গ্রাহকেরা যাতে এমএফএস অর্থাৎ বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চাঁদা দিতে পারে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের আগস্টে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল।

এ ছাড়া পেনশন কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ও  অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের দি সিটি ও ব্র্যাক ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এ ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পেনশনের চাঁদা জমা হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। চাঁদা গ্রহণে বেসরকারি আরও চার ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ব্যাংকগুলো হচ্ছে প্রাইম ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। এর বাইরে জনতা ব্যাংক চুক্তি করতে নীতিগতভাবে রাজি হলেও পেনশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, প্রস্তুতি নিতে ব্যাংকটির আরও কিছু সময় লাগবে। 

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা প্রথমআলোকে বলেন, ‘কোনো গ্রাহক যদি কোনো দিনও ব্যাংক হিসাব না খোলেন, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। পেনশন পাওয়ার সময় হলে তিনি এমএফএসের মাধ্যমেই তা পাবেন।’ গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, ‘পেনশন কর্মসূচি নিয়ে সম্প্রতি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি, আগামী ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ৬৪ জেলায় পেনশন মেলা হবে। তখন আরও বেশি সাড়া পাওয়া যাবে।’ সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির গ্রাহক এক লাখ ছাড়ানোর পর গত ২৯ এপ্রিল কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাবি করেছে, এটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।

সর্বজনীন পেনশনের আওতায় বর্তমানে চালু রয়েছে চার ধরনের পেনশন কর্মসূচি। প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা—চলমান এই চার কর্মসূচির বাইরে প্রত্যয় নামে আরেকটি নতুন কর্মসূচি চালু হবে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। আগামী ১ জুলাইয়ের পর থেকে যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দেবেন, তাঁদের জন্য প্রযোজ্য হবে এ কর্মসূচি।

জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে মাঠ প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠন করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও সমন্বয় কমিটি। মাঠ প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা।

পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদেরও বিভাগভিত্তিক তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) নিয়মিতভাবে বিভাগ, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক নিবন্ধন তদারকি ও বাস্তবায়ন করছেন। বিভাগীয় পর্যায়ে সর্বজনীন পেনশন মেলা ও কর্মশালার আয়োজন করে সব শ্রেণি–পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে গত ১৯ এপ্রিল প্রথমবারের মতো রাজশাহীতে বিভাগীয় পেনশন মেলা ও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর ৫ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে রংপুরে। পরে বাকি ছয় বিভাগেও ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হবে বিভাগীয় পেনশন মেলা।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর চাঁদা দিয়ে আজীবন পেনশন–সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে কোনো গ্রাহক মারা গেলে ওই পেনশনারের নমিনি পেনশন কর্মসূচি গ্রহণকারীর ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার বাকি সময় পর্যন্ত পেনশন পাবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল তাঁর জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন
করা যাবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বার্ষিক আয় এবং গ্রাহকদের আর্থিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি-উভয় দিক থেকেই জাতীয় পেনশন কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা আছে। ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি এমএফএস নম্বরের মাধ্যমে নিবন্ধন করার সুযোগ তৈরির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, সুবিধাগুলো বুঝিয়ে বলতে পারলে পেনশন কর্মসূচিতে মানুষ আকৃষ্ট হবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের দিক থেকে প্রচার কার্যক্রমের
ঘাটতি আছে।