জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট বন্ধক রেখেই বেশি ঋণ করেন দেশের মানুষ

গত এপ্রিল-জুন প্রান্তিক শেষে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোয়া ৯ লাখ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে জামানত জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট।

বাংলাদেশ ব্যাংকছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি ঋণ করেন জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে। ব্যাংকগুলো যত ঋণ বিতরণ করে, তার প্রায় ৬৪ শতাংশের বিপরীতে আবাসন বা রিয়েল এস্টেট–সংশ্লিষ্ট সম্পদ বন্ধক রাখা হয়। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয় ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টির বিপরীতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্রই পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিক পর্যন্ত সব ব্যাংকের ঋণের স্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট বন্ধক রাখা হয়েছে। আর ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তার বিপরীতে বিতরণ করা হয়েছে ২ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ। সেই হিসাবে উল্লেখিত প্রান্তিক পর্যন্ত ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের প্রায় এক–চতুর্থাংশের বিপরীতে জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট এবং ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক নিশ্চয়তাকে জামানত রাখা হয়।

আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী, কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব সম্পদ যথাযথভাবে নিবন্ধন করা হয়।
আনিস এ খান, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক

জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক নিশ্চয়তার বাইরে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শেয়ার, রপ্তানি পণ্য ও রপ্তানির নথিপত্র, শিল্পের যন্ত্রপাতি ও সম্পদ এবং আর্থিক দায়কে জামানত রাখা হয়। এর মধ্যে দেশে সবচেয়ে কম ঋণ বিতরণ হয় শেয়ার বা সিকিউরিটিজ বন্ধক রেখে। গত জুন মাস পর্যন্ত শেয়ার ও সিকিউরিটিজ বন্ধক রেখে ব্যাংকগুলো প্রায় ৯ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটের চাহিদা সব সময়েই থাকে। এসব জামানত বিক্রি করাও সহজ। কারণ, ক্রেতা পাওয়া যায়। তাই ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট বন্ধক নিতে আগ্রহী হয় বেশি।

 এ বিষয়ে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী, কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব সম্পদ যথাযথভাবে নিবন্ধন করা হয়। তাই এসব সম্পদ যাচাই করা ব্যাংকের জন্য সহজ। আবার এ ধরনের সম্পদের চাহিদা সব সময় থাকে, তাই বিক্রি করাও সহজ। এসব কারণে ঋণের বিপরীতে জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট বেশি বন্ধক রাখা হয়।’

এ ছাড়া এর পেছনে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও কাজ করে বলে মনে করেন আনিস এ খান। তিনি বলেন, সাধারণত দেখা যায় বাড়ি, জমি বা ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে কেউ ঋণ নিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই ঋণ পরিশোধে গ্রাহকের একধরনের তাগিদ থাকে।

কারণ, বেশির ভাগ ঋণগ্রহীতা চান না তাঁর জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট হাতছাড়া হয়ে যাক। তাই এ ধরনের সম্পদ বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়া হলে সেই ঋণ পরিশোধে একধরনের পারিবারিক চাপও থাকে। এসব বিবেচনায় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট বেশি পছন্দের।

ব্যাংকাররা বলছেন, বিদেশে ব্যক্তিগত অনেক ধরনের সম্পদ জামানত রেখে ঋণ দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত গাড়ি, স্বর্ণালংকার, শিল্পের যন্ত্রপাতিসহ নানা ধরনের সম্পদ জামানত রাখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের প্রবণতা কম। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, যেসব সম্পদের বাজার বা দামে অস্থিরতা বেশি থাকে, সে ধরনের সম্পদ জামানত নিতে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কম থাকে। একই কারণে শেয়ার বা সিকিউরিটিজ বন্ধক রেখে কম ঋণ দেওয়া হয় বলে ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল-জুন প্রান্তিক পর্যন্ত যত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার মধ্যে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণে আমানত রাখা হয়েছে স্থায়ী আমানত বা বন্ডের বিনিয়োগকে। আর শিল্পের যন্ত্রপাতি বা স্থায়ী সম্পদ জামানত রেখে বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ।

আনিস এ খান বলেন, যেসব সম্পদের বাজার চাহিদা কম, সেসব সম্পদকে খুব বেশি জামানত হিসেবে রাখতে চায় না ব্যাংক। এ কারণে আমাদের দেশে ঋণের জামানত ঘুরেফিরে জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মধ্যেই বেশি সীমাবদ্ধ।

 ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, অনেক সময় জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে বেশি ঋণ নেওয়া যায়, এ কারণে ঋণগ্রহীতারা এসব সম্পদকে জামানত হিসেবে ব্যবহার করতে বেশি আগ্রহ দেখান।