আইন নেই, তদন্তও নেই

  • আইন সংশোধন চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে দুদকের চিঠি।

  • আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দুই বছরেও আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়নি।

বিমা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তা তদন্ত করতে পারছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কারণ, দেশের প্রচলিত কোনো আইনেই তাঁদের জনসেবক (পাবলিক সার্ভেন্ট) বলা হয়নি।

দুই বছর আগে দুদকের তৎকালীন মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত দায়িত্বের সচিব মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী বিমা খাতে তদন্ত করতে না পারার সমস্যাটি চিহ্নিত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। দুদকের পক্ষে মুনীর চৌধুরী ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি পাঠানো ওই চিঠিতে জনস্বার্থে আইন সংশোধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এর পাঁচ মাস আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হয়ে আসেন আসাদুল ইসলাম, যিনি এখনো সেখানেই আছেন।

এদিকে গত ১৪ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়ার আগে দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্তও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়ে একই অনুরোধ করে গেছেন। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দুই বছর ধরেই প্রস্তাব ফেলে রেখেছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বিদেশে থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিগগির আমরা চিঠিটি বিচার-বিশ্লেষণ করব। সব দিক ভেবেই পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

উভয় চিঠিতেই দুদক বলেছে, বিমা কোম্পানিগুলো বিমাসংক্রান্ত কাজ করলেও মূলত জনগণের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করাই তাদের কাজের প্রকৃতি। তাদের মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। কিন্তু ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯৩ সালের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন এবং ২০১০ সালের বিমা আইন—কোনোটিতেই বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের পাবলিক সার্ভেন্ট বলা হয়নি।

চিঠিতে বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংজ্ঞায় দুদককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সংজ্ঞাটিরই সংশোধন দরকার। আর ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ১১০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী যে অর্থে জনসেবক কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে, সে অর্থে ব্যাংক কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক, নিরীক্ষক, অবসায়ক, ব্যবস্থাপক এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীও জনসেবক বলে গণ্য হবেন।’

দেশে বর্তমানে ৭৮টি বিমা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, যার মধ্যে জীবনবিমা কোম্পানি ৩২টি এবং নন-লাইফ বা সাধারণ বিমা কোম্পানি ৪৬টি। ৭৮টির মধ্যে রয়েছে সরকারি মালিকানাধীন জীবন বীমা করপোরেশন ও সাধারণ বীমা করপোরেশন। এ ছাড়া বিদেশি কোম্পানি মেটলাইফ শাখা কার্যালয়সহ কাজ করছে। ভারতের সঙ্গে যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি হিসেবে আছে এলআইসি বাংলাদেশ লিমিটেড।

আইনে বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জনসেবক বলা হয়নি বলে তদন্তে বাধা আছে দুদকের।

এ বিষয়ে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আইন সংশোধনের এখতিয়ার সরকারের। তবে আর্থিক খাতের মধ্যে ব্যাংক খাতের পর্ষদ সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি জনসেবক হন, বিমা খাতের একই ধরনের ব্যক্তিরাও জনসেবক।

বিমা কোম্পানিগুলোর দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ এলেও তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য না থাকায় এবং বিমা কোম্পানির পর্ষদ সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনসেবক হিসেবে বিবেচিত না হওয়ায় এগুলোর কোনো প্রতিকার করা সম্ভব হচ্ছে না—দুদকের চিঠিতে এসব কথাও উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া দুদকের উভয় চিঠিতেই ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসরণ করে বিমা কোম্পানির পর্ষদ সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জনসেবক হিসেবে গণ্য করতে বিমা আইন সংশোধন করা উচিত বলে মত দেওয়া হয়েছে।

তবে বিমা কোম্পানির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরাম (বিআইএফ) আইন সংশোধনের বিষয়ে চুপচাপ রয়েছে। তাদের কোনো বিষয় দুদক তদন্ত করুক, তা তারা চায় না। আবার না চাওয়ার পেছনে শক্ত কোনো যুক্তিও তুলে ধরতে পারছে না তারা।

জানতে চাইলে বিআইএর চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক-বিমা দুটোই আর্থিক খাত, দুটোই সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু ব্যাংক খাতের কাছে মুনাফাটা আগে, সেবাটা পরে। আর বিমা খাতের কাছে সেবাটা আগে, মুনাফাটা পরে। তবে সরকার চাইলে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করতেই পারে।

অন্যদিকে বিআইএফের চেয়ারম্যান বি এম ইউসুফ আলী কোনো মন্তব্য করতেই রাজি হননি।