জমি ও বাড়ির পেছনেই বেশি খরচ

দেশে প্রতিবছর যত প্রবাসী আয় আসে, তার বড় অংশই খরচ হয় বাড়ি করতে ও জমি কেনায়। যেসব পরিবারে প্রবাসী আয় আসে, সেসব পরিবার অন্যান্য পরিবারের চেয়ে বেশি অর্থ জমি ও বাড়ির পেছনে খরচ করে। আবার প্রবাসী আয় বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারগুলোর খাবার বাবদ আনুপাতিক খরচ কমতে থাকে।

প্রবাসী আয় কোন খাতে কীভাবে খরচ হচ্ছে, তা নিয়ে জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটির নেতৃত্ব দেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নালে ‘ইমপ্যাক্ট অব ফরেন রেমিট্যান্স অন দ্য হাউসহোল্ড স্পেন্ডিং বিহেভিয়ার ইন বাংলাদেশ বা পরিবারের ব্যয়ে প্রবাসী আয়ের প্রভাব’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ এ বছরের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়। সেলিম রায়হানের সঙ্গে এ প্রবন্ধের সহলেখক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মাহতাব উদ্দিন ও একই বিভাগের শিক্ষার্থী শাকিল আহম্মেদ।

প্রবন্ধে বলা হয়েছে, সাধারণত দরিদ্র পরিবারগুলোর সিংহভাগ খরচ হয় খাবারের পেছনে। অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবারগুলো অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়াতে থাকে। এ কারণে প্রবাসী আয় গ্রহীতা পরিবারগুলোর আয় বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের খাবার বাবদ খরচও কমতে থাকে।

এদিকে, করোনা মহামারির মধ্যেও প্রবাসী আয় সূচকে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রবাসী আয়ের কারণে মানুষের জীবন মানের উন্নতি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। সেলিম রায়হানের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় পরিবারে প্রবাসী আয়ের প্রভাব নিরূপণে সাতটি শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়। সেগুলো হলো খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী পণ্য, ভূমি ও গৃহায়ণ, বিনিয়োগ ও অন্যান্য পণ্য। ২০১৬ সালের খানা আয় ব্যয় জরিপের ভিত্তিতে গবেষকেরা দুটি তুলনামূলক দল তৈরি করেন—একদিকে ছিল প্রবাসী আয় গ্রহীতা পরিবার আর অন্যদিকে প্রবাসী আয় পায় না এমন পরিবার। এতে দেখা যায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাবদ প্রবাসী আয় গ্রহীতা পরিবারের ব্যয় অন্য পরিবারের চেয়ে বেশি। প্রবাসী আয় গ্রহীতা পরিবারগুলো বছরে মোট ব্যয়ের ৫ দশমিক ১ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করছে, সেখানে যেসব পরিবার প্রবাসী আয় পায় না, তারা ব্যয় করছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থ। একইভাবে শিক্ষা খাতে এ ব্যয় ৭ দশমিক ৪ শতাংশের বিপরীতে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পেছনে খরচ বৃদ্ধি করে—জরিপে এ প্রবণতা উঠে এসেছে।

জরিপের তথ্য পর্যালোচনা করে আরও বলা হয়েছে, ঘুরে বেড়ানো, জামাকাপড় কেনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও আসবাব কেনায় প্রবাসী আয় গ্রহীতা পরিবারগুলো এগিয়ে আছে। এই খাতে পরিবারগুলোর খরচ মোট ব্যয়ের ২৩ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে অন্যরা ব্যয় করে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া প্রবাসী আয় গ্রহীতা ও প্রবাসী আয় নেই এমন পরিবারের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা গেছে বিনিয়োগ ও ভূমি বাবদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে। প্রবাসী আয় গ্রহীতা পরিবারগুলো যেখানে মোট ব্যয়ের ১৯ দশমিক ১ শতাংশ কৃষি ও ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে, সেখানে অন্য পরিবারগুলো ব্যয় করছে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। জমি কেনা ও বাড়ি তৈরিতে প্রবাসী আয় গ্রহীতা পরিবারগুলো যেখানে ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যয় করছে, সেখানে অন্য পরিবারগুলোর ব্যয় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসী আয় ব্যবহারের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকায় মূলত জমি কেনা ও বাড়ি বানানোর পেছনে এ অর্থ বেশি খরচ হচ্ছে। আবার বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে লোক দেখানোর জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ও করা হচ্ছে। তাঁর মত, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রবাসী আয় বিনিয়োগের জন্য বিশেষ বন্ড এবং স্থানীয় পর্যায়ে এই অর্থ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা দরকার। এনিজওদের এ ক্ষেত্রে যুক্ত করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।

দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে অভিবাসীদের পাঠানো অর্থের ভূমিকা অপরিসীম বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। ২০১৬ সালের খানা আয় ব্যয় জরিপের তথ্যানুসারে, গ্রামীণ দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে প্রবাসী আয় প্রাপ্ত খানায় যেখানে অতি দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, অন্যান্য খানায় তা ১৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। করোনার অভিঘাত থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতেও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের বড় ভূমিকা রয়েছে।

ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব

গবেষকেরা বলছেন, জমি কেনা ও বাড়ি নির্মাণ বা সংস্কারের পরিবারের ব্যয়ের ওপর পরিবারের কর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রভাব আছে। যেমন বলা হয়েছে, পরিবার কর্তার উচ্চতর ডিগ্রি থাকলে শিক্ষা খাতে ব্যয় ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আবার পরিবারের কর্তা নারী হলে শিক্ষায় ৩ দশমিক ২ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি পায়। জমি কেনা ও বাড়ি নির্মাণ বা সংস্কারের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী পরিবার কর্তা এ খাতে বেশি ব্যয় করেন। তেমনি এরা খাবারে আনুপাতিকভাবে কম ব্যয় করেন।