এস আলম নিয়ে গভর্নর বললেন, ‘চোরের মায়ের বড় গলা’

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরফাইল ছবি প্রথম আলো

নিজেকে বাংলাদেশি নাগরিকের পরিবর্তে সিঙ্গাপুরি নাগরিক দাবি করে এস আলম গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার সাইফুল আলম সরকারের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে, সেই ঘটনাকে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

সচিবালয়ে আজ রোববার ‘বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গঠিত আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স’–এর বৈঠক শেষে গভর্নর এ কথা বলেন।

গভর্নর বলেন, ‘ওয়াশিংটনে মামলা করেছে এস আলম আমাদের বিরুদ্ধে। চোরের মায়ের বড় গলা। এস আলম বাংলাদেশি নাগরিক, সিঙ্গাপুরি নন। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে চেয়ারম্যান, পরিচালক ছিলেন। সে হিসেবে আমরা এ মামলা লড়ব।’

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পাচার করা অর্থ যুক্তরাজ্য থেকে ফেরত আনার ব্যাপারে অগ্রগতি আছে বলেও জানালেন গভর্নর।

অর্থ ফেরত আসার বিষয়ে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘আমরা সম্ভবত খুবই ভাগ্যবান হব যে লন্ডন থেকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মামলার সমাধান যদি হয়ে যায়। কারণ, মামলাটি তারা লড়েনি। ফলে এমনিতেই তারা মামলাটি হেরে গেছে। সেখানে একটা সুযোগ আছে। সে টাকা কবে আসবে বলতে পারব না। ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে বা জুন মাস নাগাদ সময় লাগতে পারে। এগুলো লম্বা প্রক্রিয়া। আমাদের ধারণা, সাইফুজ্জামান চৌধুরী আপিল করবে না।’

টাস্কফোর্সের প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। গভর্নরের নেতৃত্বাধীন দল আজ অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে। অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রমুখ এতে উপস্থিত ছিলেন।

তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘অগ্রগতি হচ্ছে। তবে পাচার হওয়া অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে।’

কী পরিমাণ মামলা চিহ্নিত করা গেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘সংখ্যা এ মুহূর্তে মনে নেই। তবে অনেক মামলা হয়েছে।’

যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের তদন্ত

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার এবং ১০ শিল্পগোষ্ঠীর ব্যাংকঋণে অনিয়ম, কর ফাঁকি, অর্থ পাচারসহ নানা অনিয়মের তদন্ত চলছে। তাদের মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও আরামিট গ্রুপ।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বয়ে যৌথ তদন্ত দল তদন্তগুলো করছে। সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

তদন্ত সংস্থাগুলোর কাছে এখন পর্যন্ত যত তথ্য এসেছে, তাতে এস আলম গ্রুপের সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও পাচারের তথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে। গ্রুপটি ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, এসআইবিএল, গ্লোবাল, ইউনিয়ন, জনতা, এক্সিমসহ ১১ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি সরিয়েছে। এর মধ্যে অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এসব অর্থের একটা অংশ দেশের বাইরে চলে গেছে। এখন পর্যন্ত ৬টি দেশে গ্রুপটির একাধিক তারকা হোটেল, জমি ও সম্পদ থাকার তথ্য মিলেছে।

সূত্রগুলো জানায়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবার এবং আরামিট গ্রুপের নামে থাকা দেশ-বিদেশের ৫৮০ বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, জমিসহ স্থাবর সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, ইউএইতে ২২৮টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বাড়ি রয়েছে। বেসরকারি খাতের ইউসিবি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিবারের কাছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোর মোট ঋণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থ পাচার করে লন্ডন ও সিঙ্গাপুরে গ্রুপটির পরিবারের নামে সম্পদ থাকার তথ্য পেয়েছে তদন্ত সংস্থাগুলো।

দেশে বসুন্ধরা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ থাকার তথ্য মিলেছে, এর মধ্যে কিছু ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানসহ তাঁর পরিবারের আট সদস্যের বিদেশে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্লোভাকিয়া, সাইপ্রাস, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে বসুন্ধরার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজ মিলেছে, এ জন্য সম্পদ জব্দের আদেশের অনুলিপি এসব দেশে পাঠানো হয়েছে।

সিকদার গ্রুপ নামে–বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি সরিয়েছে। সিকদার পরিবারের সম্পদ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্ক, প্রমোদনগরী হিসেবে খ্যাত লাস ভেগাস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি ও থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডে রয়েছে সিকদার পরিবারের একাধিক কোম্পানি।

ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের ৩১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ ও একটি ফ্ল্যাটসহ ৪৩ একর জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের যুক্তরাজ্যে পাঁচটি বাড়ি, আইলে অব ম্যানে একটি ও জার্সিতে একটি বাড়ির খোঁজ মিলেছে। এসব সম্পদ অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। নাবিল গ্রুপ নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি সরিয়েছে। সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খানসহ তাঁর পরিবারের ১১ জন সদস্যের ১৯১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সরকারি প্লট বেআইনিভাবে নিজেদের নামে করিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা, টিউলিপ সিদ্দিকসহ শেখ পরিবারের ছয় সদস্য ও একাধিক রাজউক কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। যুক্তরাজ্যে টিউলিপের একাধিক ফ্ল্যাটের খোঁজ মিলেছে। তবে জেমকন গ্রুপের বড় কোনো অনিয়মের খোঁজ পাননি তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।