ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ আইন আসছে, সময়মতো পণ্য না দিলে তিনগুণ জরিমানা

দেশে ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ আইন হচ্ছে। এ আইন পাস হলে ডিজিটাল বাণিজ্য খাত শৃঙ্খলায় ফিরবে বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ই–কমার্সপ্রতীকী ছবি

উদীয়মান ই–কমার্স খাতের বিকাশ ও এ খাতকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে সরকার অবশেষে ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ গঠনের পথে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ জন্য ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রি পরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে। আজ  বৃহস্পতিবার তা উঠছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ‘আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক মতামত প্রদান সংক্রান্ত কমিটি’র বৈঠকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, প্রথমে চিন্তা করা হয়েছিল ডিজিটাল বাণিজ্য আইন করা হবে। পরে ভাবা হয় ডিজিটাল বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন তৈরির। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, আইনের নাম হবে ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ আইন। আইন পাসের পর গঠন করা হবে কর্তৃপক্ষ।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ থেকে লাইসেন্স নিয়েই দেশে ই–কমার্স বা ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। ডিজিটাল কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিটি (ডিবিআইডি) নিবন্ধন দেবে এ কর্তৃপক্ষ। প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করলে কর্তৃপক্ষ সেই নিবন্ধন বাতিলও করে দেবে।

ডিজিটাল বাণিজ্যে দেশি উদ্যোক্তাদের বাজার সম্প্রসারণ ও রপ্তানি বৃদ্ধি, ডিজিটাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অনলাইন কার্যক্রম পরিদর্শন, যে কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত করা এবং এসব কাজে সহায়তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবে এ কর্তৃপক্ষ।

বাণিজ্যসচিব মো. সেলিম উদ্দিন  বুধবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ মন্ত্রণালয়ে নতুন যোগ দিয়েছেন। আইনের বিষয়টি নিয়ে কর্মদিবসে খোঁজ নিয়ে তিনি কথা বলতে পারবেন, তার আগে নয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক মতামত প্রদান–সংক্রান্ত কমিটি থেকে মতামত আসার পর খসড়া চূড়ান্ত করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং পরে তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠাবে।

দেশে কখন ডিজিটাল বাণিজ্য শুরু

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই–ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ই–কমার্স বা ডিজিটাল বাণিজ্য শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। তবে পূর্ণাঙ্গ ও পেশাদার ই-কমার্সের যাত্রা শুরু তারও ১০ বছর পর অর্থাৎ ২০০৯ সালে। এ খাতের বিকাশ শুরু ২০১৪ সালে। এর পরের বছর ২০১৫ সালে সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পায় ই–ক্যাব।

২০১৮ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন করে। ই-কমার্স খাতের ব্যক্তিদের মতে, এটা একটা ‘নামকাওয়াস্তে’ নীতিমালা। বিদেশিদের বিনিয়োগ করা বিষয়ে কিছু ছিল না নীতিমালায়। বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে নীতিমালা সংশোধন করা হয় ২০২০ সালের জুনে। তখন করোনার প্রকোপ। এর দুই মাস পর আগস্টে গণমাধ্যমে উঠে আসে দেশের অন্যতম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির অপকীর্তির নানা খবর। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন বা এটুআই (বর্তমানে অ্যাসপায়ার টু ইনোভেশন) প্রকল্প উদ্যোগী হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ‘বেসরকারি খাত উন্নয়নে নীতি সমন্বয় কমিটি’ ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর এক বৈঠকে ই-কমার্স নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে ই-কমার্সের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও এটুআই যৌথভাবে ‘এসক্রো সেবা’ চালু করবে।

এ ব্যবস্থায় গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা পাওয়ার কথা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। তার আগে জমা থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের কাছে। কিন্তু কাজটি যথাসময়ে হয়নি। ডিজিটাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো কী মেনে চলবে কি মেনে চলবে না—এ ব্যাপারে একটি নির্দেশিকা শেষ পর্যন্ত তৈরি হয় ২০২১ সালের মাঝামাঝি এসে। তত দিনে যে ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। পাওনা আদায়ে গ্রাহকদের নামতে হয় রাজপথে। মিছিল, সমাবেশ, রাস্তা অবরোধ পর্যন্ত করেছেন প্রতারিত গ্রাহকেরা।

কেন করা হচ্ছে এ আইন

প্রধানমন্ত্রী ও ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। তৃতীয় সভাটি হয়েছিল ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রধানমন্ত্রীকে চেয়ারপারসন করে ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ।

আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ও স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের নির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠকেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর গঠিত স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ওই বছরের ১৩ নভেম্বর।

এ মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, ডিজিটাল বাণিজ্য বাণিজ্যেরই অংশ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যক্রম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারেই থাকবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে কারণেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আইনের খসড়া তৈরি করেছে।

ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এ আইন যদি আগে হতো এবং আইনের বলে যদি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হতো, তাহলে এত বিপদে পড়তাম না।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরের কাজ সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। এখন গড়ে উঠবে স্মার্ট বাংলাদেশ। এ জন্য সব খাতে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রচলিত বাণিজ্যপদ্ধতি পর্যায়ক্রমে বাণিজ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। ডিজিটাল বাণিজ্য ঠিকভাবে তদারকি ও পরিচালনার জন্যই দরকার একটা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের। ডিজিটাল বাণিজ্যের বিকাশ, শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তসীমান্ত ডিজিটাল বাণিজ্য–সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধ চিহ্নিত করা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কেও আইন থাকা দরকার।

ই–কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই–ক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে খসড়া বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, নিবন্ধন ছাড়া ব্যবসা করা ছোট ছোট ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিমানার অঙ্কটা বেশি আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা আরেকটু যৌক্তিক করা যেতে পারে।’

কী থাকছে আইনে

প্রতারণার অপরাধে মামলা ও জরিমানা করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য বিক্রি করলে অনলাইন বিক্রেতাকে দুই বছরের কারাদণ্ড, অনাদায়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান থাকবে। নির্ধারিত সময়ে পণ্য বা সেবা সরবরাহ না করলে মূল্যের তিন গুণ জরিমানা আরোপ করবে কর্তৃপক্ষ। অনাদায়ে তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেবে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা হবে। এসব কথা বলা হয় খসড়া আইনে। 

আরও বলা হয়েছে, অনুমতি ছাড়া ডিজিটাল বা গিফট কার্ড, ওয়ালেট, ক্যাশ ভাউচার করলে ছয় মাস কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লটারির আয়োজন করলে দুই বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। আইনের যেকোনো ধারা লঙ্ঘনে দায়ের করা মামলা প্রথম শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রট আদালতে বিচার্য হবে। তবে ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা-ই থাকুক, বিধিমালায় বর্ণিত সব অপরাধ জামিনযোগ্য হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিবকে চেয়ারপারসন করে গঠন করা হবে ‘ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ। থাকবেন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের তিনজন সদস্য। এর কেন্দ্রীয় দপ্তর থাকবে ঢাকায়। সরকার চাইলে ঢাকার বাইরে এক বা একাধিক শাখা কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে। কর্তৃপক্ষের অধীন একটি পরামর্শক কাউন্সিল থাকবে। 

ডিজিটাল বাণিজ্যের প্রসার, শৃঙ্খলা রক্ষা, বাণিজ্য–বিরোধ নিষ্পত্তি ও অপরাধ প্রতিরোধের তদারক করবে কর্তৃপক্ষ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য ও সেবা কেনাবেচা ও সংরক্ষণ হয় কি না; কোনো ওষুধপণ্যের মোড়কে সঠিক ব্যবহারবিধি, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছাড়া অনলাইনে বিক্রি হয় কি না; অসত্য ও অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন বা বিক্রি প্রস্তাব দিয়ে ক্রেতা ও গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা হয় কিনা, কর্তৃপক্ষ এগুলোও তদারক করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক সুবর্ণ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, আইনের খসড়ায় কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের সরল বিশ্বাসের কার্যক্রমকে দায়মুক্তির প্রস্তাব দেওয়ার কতা বলা হয়েছে। এ রকম দায়মুক্তি তাদের অসদাচরণ, দুর্নীতি বা অনিয়মকে উৎসাহিত করবে বলে তা বাদ দেওয়া যেতে পারে।

সুবর্ণ বড়ুয়া বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো ব্যবসায়ীর ব্যাপারে তদন্ত করতে পারবে, যাতে সহযোগিতা করবে কর্তৃপক্ষ—এ  ধরনের একটি ধারা সংযোজন করা যেতে পারে।