চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চান ব্যবসায়ীরা

আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সরবরাহ এবং মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য এই মতবিনিময় সভা করেছে এফবিসিসিআই।

আজ বুধবার মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনের মিলনায়তনে এফবিসিসিআইয়ের মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীদের একাংশছবি-প্রথম আলো

পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে হলে করপোরেট কোম্পানিগুলোকে ঠিকমতো পণ্য সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের নজরদারিও রাখতে হবে। এ ছাড়া চিনি, খেজুর ও ফলমূলের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে আমদানি শুল্ক যৌক্তিক করা জরুরি। একই সঙ্গে চাঁদাবাজি বন্ধেও সরকারকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি বা এফবিসিসিআইয়ের আয়োজনে মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন নিত্যপণ্যের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী নেতারা। আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সরবরাহ এবং মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য এই মতবিনিময় সভা করেছে এফবিসিসিআই। মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনের মিলনায়তনে আজ বুধবার অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন এফবিসিসিআইয়ে নিযুক্ত প্রশাসক মো. আবদুর রহিম খান।

সভায় নিত্যপণ্যের আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী, ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। শুরুতে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা ও জোগান নিয়ে একটি উপস্থাপনা দেন এফবিসিসিআইয়ের মহাসচিব মো. আলমগীর।

বাজার তদারকিতে যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে দৃষ্টি না সরাবেন, ততক্ষণ সমস্যার সমাধান হবে না। কারওয়ান বাজারের চুনোপুঁটি ব্যবসায়ীর কাছে না গিয়ে রাঘববোয়ালের কাছে যান।
—গোলাম মওলা, সাধারণ সম্পাদক, মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতি

এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুর রহিম খান সভাপতির বক্তব্যে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থাকে অনুরোধ করা হবে, যাতে চাঁদাবাজি না হয়। নিত্যপণ্য পরিবহনে কোনো বিঘ্ন না ঘটে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ অন্য সংস্থার প্রতি আহ্বান থাকবে ভোক্তাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার।

‘চাঁদাবাজির প্রলয় শুরু হয়েছে’

মতবিনিময় সভায় পুরান ঢাকার শ্যামবাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘দুর্ভাগ্যের বিষয়, করপোরেট ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষদের শকুনের মতো শোষণ করছেন। ৩ টাকার মোড়ক দিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে ৪০ টাকা। অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।’ ফরিদ উদ্দিন আরও বলেন, ‘চাঁদাবাজির প্রলয় শুরু হয়েছে। ট্রাক থেকে পণ্য নামাতে চাঁদা দিতে হয়। আবার ট্রাকে পণ্য ওঠাতে চাঁদা দিতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও চাঁদাবাজদের সঙ্গে “দহরম-মহরম” রয়েছে। এসব বন্ধ করতে হবে।’

চাঁদাবাজির প্রলয় শুরু হয়েছে। ট্রাক থেকে পণ্য নামাতে চাঁদা দিতে হয়। আবার ট্রাকে পণ্য ওঠাতে চাঁদা দিতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও চাঁদাবাজদের সঙ্গে ‘দহরম-মহরম’ রয়েছে।
-ফরিদ উদ্দিন, সভাপতি, শ্যামবাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতি

কারওয়ান বাজারের আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, পেঁয়াজের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ১০ শতাংশের জন্য সংকট হচ্ছে। ইতিমধ্যে পেঁয়াজের দামে সেঞ্চুরি হয়েছে। সরকার এখন আমদানির প্রয়োজন অনুভব করছে। আগে কেন এই প্রয়োজন অনুভব করল না। দ্রুত আমদানির সিদ্ধান্ত না নিলে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, বাজারে সয়াবিন তেলের দাম অভিন্ন হতে হবে। একেক গ্রুপ একেক ধরনের দাম নিচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে। তাহলে তেলের দামে শৃঙ্খলা আসবে। চাঁদাবাজি বন্ধের আহ্বানও জানান তিনি।

ব্যবসা-বাণিজ্য চাঁদাবাজমুক্ত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের কথা কেউ শোনে না। চাঁদাবাজমুক্ত পরিবেশ তৈরি না হলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে না।’

‘রাঘববোয়ালের কাছে যান’

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা বলেন, ‘বর্তমানে চিনি ও ভোজ্যতেল সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কমে বিক্রি হচ্ছে। সাতটি গ্রুপ কাঁচামাল আমদানি করে পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ করে। আমরা সবাই তাদের ওপর নির্ভরশীল। রোজায় চাহিদা ও জোগান ঠিক থাকলে কোনো সমস্যা হবে না।’

গোলাম মওলা আরও বলেন, ‘বাজার তদারকিতে যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে দৃষ্টি না সরাবেন, ততক্ষণ সমস্যার সমাধান হবে না। কারওয়ান বাজারের চুনোপুঁটি ব্যবসায়ীর কাছে না গিয়ে রাঘববোয়ালের কাছে যান। আমাদের শান্তিমতো ব্যবসা করতে দেন।’

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বশির উদ্দিন বলেন, সংকটের সময় ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিলগুলো বিশেষ শ্রেণির পরিবেশকদের তেল দেয়। তখন নিয়মিত পাইকারি ব্যবসায়ীরা তেল পান না। তাতে বাজার আরও অস্থির হয়ে ওঠে। এটি বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

রোজায় ভোজ্যতেল ও চিনির বাজারে সরবরাহ পর্যায়ে সমস্যা তৈরি হয় বলে জানিয়ে টি কে গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ শফিউল আতহার তসলিম বলেন, বাজারে যেহেতু এই দুটি পণ্যের সংকট তৈরি হয়; রমজানের সময় ৪-৫ লাখ টন চিনি ও ভোজ্যতেল আমদানি করতে পারে সরকার। সেটি হলে বেসরকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ওপর দায় চাপানো ও সংস্থাগুলোর হয়রানি কমবে।

চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মুহাম্মদ আবুল হাশেম বলেন, ১৩০ টাকার চিনি এখন পাইকারি বাজারে ৯০-৯১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রোজায় বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। তখন জোগান ঠিক থাকলে দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। চিনি পরিশোধন করে ৫-৬টি কোম্পানি। ঠিকমতো মজুত ও সরবরাহ থাকবে কি না, সেটি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মিলমালিকদের সঙ্গে সরকারকে বসতে হবে। কোনো সমস্যা থাকলে সমাধান করতে হবে।

মেঘনা গ্রুপের উপব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, শীতের সময় গ্যাসের চাপ কম থাকে। ফলে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। গ্যাস সরবরাহ ঠিক থাকলে চিনিকলগুলো পর্যাপ্ত চিনি সরবরাহ করতে পারবে। তাতে দামও স্বাভাবিক থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

খেজুরের শুল্ক কমানোর দাবি

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমানোর দাবি করে ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, খেজুরের আমদানিতে শুল্ক এমনভাবে বাড়ানো হয়েছে যে তা বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত হয়েছে। গুলশানের বাতেল নামে একটা দোকানে ৫ হাজার টাকা কেজি দরে খেজুর বিক্রি হয়। কিন্তু গরিব মানুষ ১০০ টাকার কেজি দরের খেজুর খায়। তবে সব খেজুরেই উচ্চ শুল্ক বসিয়ে দিয়েছেন কাস্টমসের কর্মকর্তারা। শুল্কের কারণে দাম বেড়ে গেছে।

খেজুরের মতো উচ্চ শুল্ক বসিয়ে ফলমূলও বিলাসবহুল করে ফেলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, চাহিদার ৩০-৩৫ শতাংশ ফল দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানি করা হয়। অথচ ফলের ওপর বেশি জুলুম (শুল্ক আরোপ) করা হয়েছে। তাই তিনি ফল আমদানিতে শুল্ক কমানোর দাবি করেন।

এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক আবদুর রহিম খান বলেন, ‘আমরা খেজুর ও ফলমূলে শুল্ক যৌক্তিক করার জন্য এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করব।’

মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন সুপারমার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, ভুট্টা ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি মিজানুল হক, ডাল ব্যবসায়ী জাহিদ হোসেন, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ, এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব ফরিদা ইয়াসমীন প্রমুখ।