২৫ বছর আগে কী উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা করেছিল এমটিবি। তাতে কতটা সফলতা এসেছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমাদের ব্যাংকের সব উদ্যোক্তা সবাই ভালো ব্যবসায়ী। তাঁরা বিভিন্ন ব্যাংকে সেবা নিতে গিয়ে পরবর্তী সময়ে নতুন ব্যাংক গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রাহকসেবার মানোন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক গড়ে তোলাটা ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। এ জন্য ব্যাংকের নাম ঠিক করা হয় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক অর্থাৎ একে অপরকে বিশ্বাস করবে। এই ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন অ্যাপেক্স, স্কয়ার, এসিআই, এবিসি, শেলটেক, স্বদেশ গ্রুপ, ব্রিটানিয়া ও আবুল হোসেন কোম্পানির প্রতিনিধিরা। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন স্কয়ার গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরী। এই ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করতে শুরু থেকে উদ্যোক্তারা সচেষ্ট ছিলেন। শুরুতেই তাঁরা ঠিক করে নেন, প্রতি দুই বছর পরপর চেয়ারম্যান পরিবর্তন হবে। এ জন্য এখন পর্যন্ত এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। নিয়ম মেনে চেয়ারম্যানরা গাড়িসহ বিভিন্ন সুবিধা পান, তবে এই ব্যাংকের কোনো চেয়ারম্যান এই সুবিধা নেননি। পাশাপাশি তাঁরা ব্যবস্থাপনা কমিটিকে ব্যাংক পরিচালনার বিষয়ে পুরো ক্ষমতা দিয়েছেন। এ জন্য এই ব্যাংকে কখনো দীর্ঘ সময় ধরে পর্ষদ সভা হয় না। আমরা মানুষকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছি, এই ব্যাংক পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালিত হয়। আমাদের সেবার মান অনেক ব্যাংকের তুলনায় উন্নত। ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, সেটা আমাদের কারণে হয়েছে। গত পাঁচ বছরে আমরা ব্যাংকের ঋণসেবা সম্পূর্ণ কেন্দ্রীভূত করেছি। এ ছাড়া ব্যাংকের আকারও বড় হয়েছে। পাঁচ বছরে যেসব ঋণ গেছে, তার খেলাপির হার ১ শতাংশের কম। গত বছর আমাদের ব্যাংকের আমানত ২৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। আর ঋণ ১৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। পরিচালন মুনাফা ৩৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকা।
২৫ বছর পর কেন ব্যাংকের লোগো পরিবর্তনের প্রয়োজন হলো। নতুন লোগো কী ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমরা প্রথমবার লোগো পরিবর্তন করছি। কারণ, বর্তমান লোগোটি ছিল একেবারে শুরুর দিকের। ২৫ বছরে ব্যাংকের সেবা ও গ্রাহকের মধ্যে নানা পরিবর্তন এসেছে। তাই আট-নয় মাস ধরে আমরাও পরিবর্তনের বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এখন তারুণ্যের সময়। তরুণেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে যায়, এমন গতিশীলতার কথা বিবেচনা করে আমরা নতুন লোগো করেছি। এই লোগো সময়ের ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলবে। আশা করি, মানুষ নতুন এই লোগো গ্রহণ করবে, আমাদের সঙ্গে আরও বেশি গ্রাহক যুক্ত হবেন।
শুধু লোগোতেই কি পরিবর্তন, নাকি ব্যাংকের সেবাতেও পরিবর্তন আনছেন। নতুন কী সেবা চালু করতে যাচ্ছেন।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: সেবার মানের পরিবর্তন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আমরা ভালো মানের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। যাতে গ্রাহকেরা আরও সহজে ও ঘরে বসে সেবা নিতে পারেন, আমরা সেদিকেই ঝুঁকছি। নিজেরাই অ্যাপ তৈরি ও উন্নয়ন করছি। আমাদের অ্যাপে দেড় লাখ সক্রিয় গ্রাহক আছেন। সামনে অ্যাপ থেকে সব ধরনের আর্থিক বিবরণী পাওয়া যাবে, ছোট ঋণের আবেদন করা যাবে ঘরে বসে। ফলে গ্রাহকদের সেবা নিতে ব্যাংকের কোনো শাখায় আসতে হবে না। এ ছাড়া করপোরেট গ্রাহকদের জন্য আছে পৃথক অ্যাপ। সেখানেও আগামী মার্চের মধ্যে ঋণপত্র আবেদন করা যাবে। ফলে করপোরেটদেরও সেবা নিতে ব্যাংকে আসতে হবে না। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থাৎ সেবার মান বাড়িয়ে গ্রাহকদের আরও ক্ষমতায়িত করতে চাই এমটিবি।
সব ব্যাংকই এখন ডিজিটাল সেবার দিকে ঝুঁকছে। ঋণ বাড়াতে আপনারা নতুন আর কী করছেন।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমরা আই ফার্মার, সেবা এক্সওয়াইজেডসহ বেশ কিছু আর্থিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের (ফিনটেক) সঙ্গে চুক্তি করেছি। তাদের তালিকাভুক্ত প্রতিনিধিদের ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছি। এ ছাড়া সাপ্লাই চেইন খাতেও ঋণ দিচ্ছি। গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তি করে পরিবেশকদের টপ আপের জন্য ঋণ দিচ্ছি। ২৪ ঘণ্টা এই সেবা পাচ্ছেন গ্রামীণফোনের পরিবেশকেরা। বিকাশের টাকা ব্যবস্থাপনা সেবা আমরাই প্রথম চালু করি। এ জন্য নতুন কোনো সেবা চালু করতে চাইলে প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের কাছে প্রথমে আসে।
এখন পর্যন্ত কোন খাতে কী পরিমাণ ঋণ দিয়েছে এমটিবি?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমাদের ৮০ শতাংশ ঋণ এখনো করপোরেট খাতে। ১২-১৩ শতাংশ ঋণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (এসএমই) এবং ৭-৮ শতাংশ ঋণ খুচরা খাতে। আমাদের ইচ্ছা ভবিষ্যতে ৪০ শতাংশ ঋণ যাবে এসএমই ও খুচরা খাতে আর ৬০ শতাংশ ঋণ থাকবে করপোরেট খাতে। এতে ব্যাংকের ঝুঁকি অনেক কমে আসবে। আমরা এসএমই খাতের মধ্যে মাঝারি খাতে বেশি যাব। আমরা ‘ডে লাইট’ নামে একটি ঋণের অনুমোদন চেয়েছি। দিনে ঋণ নিয়ে সন্ধ্যার আগে শোধ করতে হবে। যারা মুদি ব্যবসায়ী, মাঝারি উদ্যোক্তা, তাঁদের জন্য এই ঋণ চালু করা হবে।
সার্বিকভাবে দেশের ব্যাংক খাত এখন কেমন চলছে। সামনে পরিস্থিতি কী হবে?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমে এসেছিল, সেটি এখন আবার ধীরে ধীরে বাড়ছে। এ ছাড়া অন্য চাপ আগের মতোই আছে। ঋণ আদায় কমে গেছে। যদিও আমাদের ব্যাংক কিছুটা নিরাপদ। কারণ, আলোচিত বড় গ্রুপগুলোর ঋণ আমাদের ব্যাংকে খুব বেশি নেই। তবে এটা সত্য, যদি অন্য ব্যাংক চাপে পড়ে, তার তাপ আমাদের ওপরও কিছুটা পড়বে। পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১৭ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এটা ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এ ছাড়া ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নীতিমালায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ঋণের নিরাপত্তা সঞ্চিতিও বাড়ানো হয়েছে। এ বছর বৈদেশিক মুদ্রাবাজার থেকে আগের মতো মুনাফা করা যাবে না। সরকারের ট্রেজারি বিল–বন্ডের সুদহারও কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বড় একটা ইস্যু। সব মিলিয়ে ব্যাংকের মুনাফা কমে যাবে, চাপে থাকবে পুরো খাত। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কী হয়, সেটির ওপর বিনিয়োগসহ অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি নির্ভর করবে।