কালোটাকায় জমি-ফ্ল্যাট ২২৫১ জনের

জমি-ফ্ল্যাট ক্রয়, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ও শিল্পকারখানা স্থাপনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়।

কালোটাকা সাদা করায় সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে তেমন একটা উৎসাহ দেখাননি করদাতারা। গত অর্থবছরে শেয়ারবাজার, জমি-ফ্ল্যাট ক্রয়, ব্যাংকে রাখা অর্থ মিলিয়ে সব ধরনের কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল, ঢালাও সুযোগ দেওয়ার পরও মাত্র ২ হাজার ৩০০ করদাতা এই সুযোগ নিয়েছেন, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ৫ ভাগের ১ ভাগ। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১২ হাজার করদাতা এই সুযোগ নিয়েছিলেন।

গত অর্থবছরে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, সাম্প্রতিক সময়ে সেভাবে আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। শুধু তা–ই নয়, কালোটাকা সাদা করলে এনবিআর ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও জবাবদিহি করতে হবে না, এমন ঘোষণাও দেওয়া হয়। তারপরও এ সুযোগ নেননি করদাতারা।

গতবার কালোটাকা সাদা করায় উৎসাহ দেখা না যাওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো করহার বাড়ানো। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। বিদায়ী অর্থবছরে ২৫ শতাংশ কর এবং ওই করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিয়ে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তাতে সব মিলিয়ে করভার পড়ে ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ কারণে সাড়া কম মিলেছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক শীর্ষ কর্মকর্তা।

যে উদ্দেশ্যে এই ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়, বাস্তবে তার সুফল পাওয়া যায় না। নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দেওয়া এই ধরনের সুযোগ থেকে প্রাপ্তি যে খুব কম, সেই প্রমাণ মিলল।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যে উদ্দেশ্যে এই ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়, বাস্তবে তার সুফল পাওয়া যায় না। নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দেওয়া এই ধরনের সুযোগ থেকে প্রাপ্তি যে খুব কম, সেই প্রমাণ মিলল। তাঁর মতে, এই ধরনের সুযোগ দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা ও দুর্নীতিতে উৎসাহ দিচ্ছে।

কালোটাকায় ফ্ল্যাট-জমি কেনেন ২২৫১ জন

আয়কর অধ্যাদেশের ১৯এএএএএ ধারায় জমি ও ফ্ল্যাটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এনবিআরের সাময়িক হিসাবে, গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২ হাজার ২৫১ জন অবৈধভাবে উপার্জিত টাকায় ফ্ল্যাট ও জমি কিনেছেন কিংবা নগদ টাকা সাদা করেছেন। তাঁরা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে ওই সম্পদ কর নথিতে দেখান। এলাকাভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই ফ্ল্যাট ও জমি কেনার টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল এনবিআর। তাই আগেরবারের মতো গতবার এই সুযোগ বেশি নেননি করদাতারা। সব মিলিয়ে এ খাত থেকে এনবিআর কর পেয়েছে ১১৩ কোটি টাকা।

২০২০-২১ অর্থবছরে ১১ হাজার ৫৭৩ জন করদাতা জমি ও ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করেছিলেন। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে এই সংখ্যা ৫ ভাগের ১ ভাগে নেমে এসেছে।

শেয়ারবাজারে গেছেন মাত্র ৫১ জন

প্রতিবার বাজেট এলেই শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হয়তো ভাবেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিলেই শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কালোটাকার বড় অংশ বিনিয়োগ হবে, এমন প্রত্যাশাও তৈরি হয়। তাই শেয়ারবাজার চাঙা করতে শেয়ার কিনে এক বছর ‘লক ইন’ বা বিক্রি নিষেধাজ্ঞার শর্ত দিয়ে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। গত দুই অর্থবছরে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও তেমন সাড়া মেলেনি। প্রথমবার মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে এই সুযোগ দেওয়া হয়। ওইবার ২৮৬ জন করদাতা শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। সব মিলিয়ে ওই বছর মাত্র ৪০০ কোটি টাকা শেয়ারে বিনিয়োগ হয়েছে। কর পাওয়া যায় ৪০ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

বিদায়ী অর্থবছরে করহার বৃদ্ধি এবং জরিমানা আরোপ করায় সারা বছরে মাত্র ৫১ জন করদাতা শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করেছেন। সব মিলিয়ে ১০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ হয়েছে। কর মিলেছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯এএএএ ধারায় এই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

শিল্প খাতে বিনিয়োগ মাত্র এক কোটি টাকা

কয়েক বছর ধরে শিল্প খাতে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এত দিন এই খাতে কালোটাকা বিনিয়োগ হয়নি। কিন্তু গত অর্থবছরে শিল্প খাতে কালোটাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এ খাতে এক বছরে মোট এক কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। নয়জন বিনিয়োগকারী এই সুযোগ নিয়েছেন। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯এএএএএএ ধারায় এ সুযোগ নিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা।

প্রায় সব সরকারের আমলেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো এ দেশের করদাতাদের সামনে এই ধরনের সুযোগ আসে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত দেশে ১৭ বার এই সুযোগ পেয়েছেন করদাতারা। কিন্তু কোনোবারই তেমন সাড়া মেলেনি। সবচেয়ে বেশি সাড়া মিলেছিল ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১২ হাজার করদাতা এই সুযোগ নেন।