এ দেশের ললিতা আলুর এত চাহিদা কেন মিয়ানমারে

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মিয়ানমারে রপ্তানি হয়েছে ১১৯ মেট্রিক টন আলু। যার রপ্তানি মূল্য প্রায় ১৮ লাখ টাকা।

একটা সময় বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রপ্তানি হতো সিমেন্ট, ওষুধ, দুগ্ধজাত খাদ্য, ঢেউটিন, তৈরি পোশাক পণ্য ইত্যাদি। অথচ দুই বছর ধরে দেশটিতে রপ্তানি পণ্যের শীর্ষে রয়েছে রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও কুমিল্লায় উৎপাদিত ললিতা আলু।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, দেশে এত কিছু থাকতে ললিতা আলুর দিকে কেন নজর মিয়ানমারের। তা ছাড়া দেশে উৎপাদিত হয় নানা জাতের আলু। তার মধ্যে রপ্তানির তালিকায় শুধু ললিতা আলু কেন? এই আলু সেখানে কারা খায়?

মিয়ানমারে বাংলাদেশি ললিতা আলুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গোলাগুলি ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং দাম বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি কমে যাচ্ছে ।
মোহাম্মদ ফারুক, এমডি, শামা এন্টারপ্রাইজ

মিয়ানমারে আলু রপ্তানি হয় কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে। সম্প্রতি এ স্থলবন্দরে সরেজমিনে শুল্ক বিভাগ, আমদানি-রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনটি কারণে মিয়ানমারে বাংলাদেশি ললিতা আলুর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রথমত বাংলাদেশি ললিতা আলু দামে সস্তা। দ্বিতীয়ত রাখাইন রাজ্যে আলু চাষের যে জায়গা ছিল, তাতে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যারাক স্থাপন করায় উৎপাদন কমে গেছে। তৃতীয়ত রাখাইন রাজ্যে কর্মহীন ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে অল্প দামি পণ্যের চাহিদাও বেড়েছে।

টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১–২২ অর্থবছরে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারে ললিতা আলু রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার মেট্রিক টন, যার রপ্তানি মূল্য প্রায় ১২ কোটি ১২ লাখ টাকা। টেকনাফ স্থলবন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়েছিল সোয়া ৭ টাকা।

চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে মিয়ানমারে রপ্তানি হয়েছে ১১৯ মেট্রিক টন আলু। যার রপ্তানি মূল্য প্রায় ১৮ লাখ টাকা। বন্দরে পৌঁছাতে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়ে ১৮ টাকার বেশি।

* রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও কুমিল্লা থেকে আলু কিনে টেকনাফ স্থলবন্দরে পৌঁছাতে আগে ট্রাকভাড়া ছিল ২২ থেকে ২৮ হাজার টাকা। * জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ট্রাকভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়।

আলু রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে যায়, রপ্তানির ৯০ শতাংশ ললিতা আলু কেনা হয়েছে বগুড়া, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও কুমিল্লার বিভিন্ন আড়ত থেকে। উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুরে প্রতি কেজি আলু ৫ থেকে ৬ টাকায় পাওয়া যেত। সেই আলু ট্রাক বোঝাই করে টেকনাফ স্থলবন্দরে পৌঁছাতে খরচ পড়ত সোয়া ৭ টাকার মতো। সেই আলু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হতো। কম দামের কারণে সেখানকার মানুষের এ আলুর প্রতি ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে পরিবহন খরচ। আবার আলুর মৌসুমও শেষ। এ কারণে প্রতি কেজি আলু টেকনাফ স্থলবন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে ১৮ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। আর এই আলু মিয়ানমারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকার বেশি দামে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের আকিয়াবে প্রায় আড়াই মেট্রিক টন ললিতা আলু রপ্তানি করে শামা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারে বাংলাদেশি ললিতা আলুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গোলাগুলি ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং দাম বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি কমে যাচ্ছে। এখন বেশির ভাগ আলু রপ্তানি হচ্ছে ৪০০ কিলোমিটার দূরে রাখাইন রাজ্যের আকিয়াব (সিথুয়ে) শহরে।

ব্যবসায়ীরা জানান, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও কুমিল্লা থেকে আলু কিনে টেকনাফ স্থলবন্দরে পৌঁছাতে আগে ট্রাকভাড়া ছিল ২২ থেকে ২৮ হাজার টাকা। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর এ ভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়। তাতে ১৮ টাকার প্রতি কেজির ললিতা আলু মিয়ানমারে বিক্রি করতে হয় ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। দাম বেড়ে যাওয়ায় এ আলু কেনা কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন সেখানকার অধিবাসীরা। ফলে এখন আলুর রপ্তানি কিছুটা কমে গেছে। তবে আলুর উৎপাদন মৌসুমে দাম কিছুটা কমলে ব্যবসা আবার চাঙা হতে পারে।

টেকনাফের আলু ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কাসেম ও আবদুর রাজ্জাক বলেন, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির ও কক্সবাজারের হোটেল–রেস্তোরাঁয় ললিতা আলুর ব্যবহার বেশি হলেও স্থানীয় লোকজন দেশি আলু খেতে অভ্যস্ত। দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাসহ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশি ললিতা আলুর দিকে ঝুঁকেছিলেন। কারণ, তাঁদের আয়রোজগার কমে গেছে।

টেকনাফ স্থলবন্দরে আলু কিনতে আসা মিয়ানমারের ব্যবসায়ী সো উইং মং ও জু ওয়েন বলেন, রাখাইন রাজ্যে দুই বছর ধরে আলুসহ শাকসবজির চাষ কমে গেছে। চাষাবাদের জায়গাজমিগুলো এখন দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে সেখানকার মানুষের আয়রোজগারও কমে গেছে। মিয়ানমারের এই দুই ব্যবসায়ী মিয়ানমার থেকে কাঠ নিয়ে টেকনাফ বন্দরে এসেছিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় বাংলাদেশ থেকে তাঁরা ললিতা আলু নিয়ে যান। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় খুব বেশি আলু তাঁরা নিতে পারেননি। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় আলু খাওয়ার মানুষ মিয়ানমারে এখন কম।

টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট টেকনাফের মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আলুর উৎপাদন মৌসুমে প্রতি কেজি আলু ৭ থেকে ৯ টাকায় রপ্তানি সম্ভব হয়েছিল। এখন মৌসুম শেষ হওয়ায় আলুর দাম বেড়েছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে অস্থিতিশীল এক পরিস্থিতি চলছে। এসব কারণে এখন আলুর রপ্তানি কমছে।

বর্তমানে মিয়ানমার থেকে দেশে আমদানি হচ্ছে হিমায়িত মাছ, কাঠ, আদা, ডাল, নারকেল, আচারসহ নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী। আর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে আলু, নানা ধরনের গার্মেন্টস পণ্য, চিপস ইত্যাদি।