সবুজঘেরা ছোট কারখানার বড় অর্জন

সবুজের মাঝে ছোট্ট এই পরিবেশবান্ধব কারখানাই ফতুল্লা অ্যাপারেলস। গত শনিবার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকায়
ছবি: দীপু মালাকার

সাদামাটা সরু গলিটার প্রায় শেষ মাথায় অটোরিকশা থেকে নামলাম। বৃষ্টি পড়ছে। ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই হাতের ডানে ছোট একটি কারখানা ভবন। একনজর দেখেই বোঝা গেল স্থাপনাটি পুরোনো। কয়েক কদম হাঁটতেই চোখে পড়ল সবুজের সমারোহ। তর সইছিল না। ডানে নতুন দোতলা কারখানা ভবন রেখে দ্রুত সামনে এগোলাম। তখন যেন মনে হচ্ছিল, ভুল করে কোনো রিসোর্টে এসে পড়েছি। চারপাশ পরিপাটি করে সাজানো। কারখানা ভবনের পর ছোট মাঠ। গলফ মাঠের ঘাস যেমন দক্ষ হাতে ছোট ছোট করে কাটা থাকে, এখানেও ঠিক তেমন। মাঠের চারপাশে নানা রকম ফুল গাছ। এক পাশে সারি সারি ভিয়েতনামি নারকেলগাছ। তারপর একটা বড়সড় পুকুর। পাক্কা এক বিঘা। পুকুরের অপর পাড়ে আরেক সারি নারকেলগাছ।

তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। তাই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগে ছেদ দিয়ে প্রশাসনিক ভবনের দোতলায় উঠলাম। ছিমছাম আর খোলামেলা হওয়ায় ভবনের অধিকাংশ কক্ষে দিনের বেলায় বৈদ্যুতিক আলোর প্রয়োজন পড়ছে না।

নান্দনিক এই স্থাপনার মূল কান্ডারির অপেক্ষায় তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে বসলাম। একজন কর্মী এক পাশের দীর্ঘ জানালার স্বয়ংক্রিয় পর্দা সরিয়ে দিলেন। চোখের সামনে বাগান, পুকুর, কারখানা ভবনসহ সবকিছু একপলকে চোখে পড়ল। দেখার মতো এক দৃশ্য।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি সবুজঘেরা এই কারখানাটির নাম ‘ফতুল্লা অ্যাপারেলস’। দুই সপ্তাহ আগে প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) প্লাটিনাম লিড সনদ পেয়েছে। লিড-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ হলো লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। ১১০ স্কোরের মধ্যে ফতুল্লা অ্যাপারেলস পেয়েছে ৯৭। বাংলাদেশে ঘোষিত পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার মধ্যে যৌথভাবে সর্বোচ্চ স্কোর এটি। ২০১৫ সালে নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডের রেমি হোল্ডিংস ৯৭ স্কোর পায়। অবশ্য তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, একটি কারখানা ১০০ স্কোর করে লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে। ওই কারখানার নাম এখনো গোপন রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে ১৭১টি পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফতুল্লা অ্যাপারেলসের স্বত্বাধিকারী ফজলে শামীম এহসান হাজির হলেন। টুকটাক আলাপের পর তাঁর সঙ্গে এই কারখানা সত্যিকার অর্থে কতটা পরিবেশবান্ধব, তা দেখতে বের হলাম। ততক্ষণে বৃষ্টিও কমে এসেছে।

প্রশাসনিক ভবন থেকে নামার পরপরই পায়ের নিচে সিমেন্টের ব্লক দেখিয়ে ফজলে শামীম এহসান বললেন, সারা কারখানায় এই ব্লক ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ব্লকের মাঝের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বৃষ্টির পানি সরাসরি মাটির নিচে চলে যায়। এমন কিছু উদ্ভাবনের জন্য লিড প্লাটিনাম সনদে স্কোর ৬ পয়েন্ট বেশি মিলেছে বলে জানান এই উদ্যোক্তা।

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য কারখানা ভবনের নিচে বিশাল ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। তবে ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি সরাসরি ট্যাংকে আসে না। তার আগে বিশেষ ফিল্টারে সেই পানি পরিশোধিত হয়। দেশীয় প্রযুক্তিতেই ফিল্টারটি নির্মিত। বৃষ্টির পানি বাথরুমের ফ্ল্যাশ ও বাগানের কাজে ব্যবহার করা হয়। আচ্ছা, দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে ব্যবস্থা কী—প্রশ্ন করতেই ফজলে শামীম এহসান বললেন, ব্যবস্থা আছে। পুকুরের সঙ্গে ফিল্টারের একটি সংযোগ আছে। কখনো বেশি বৃষ্টিপাত হলে কারখানার নিচের ট্যাংক ভর্তি হওয়ার পর অতিরিক্ত পানি সরাসরি পুকুরে চলে যায়। আবার অনাবৃষ্টির সময় কারখানার নিচের ট্যাংকে পানি না থাকলে পুকুরের পানি ফিল্টার হয়ে ট্যাংকে চলে আসে। পুকুরে চিতল, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ করা হয় বলে জানান তিনি।

ফতুল্লা অ্যাপারেলসের মূল কারখানা ভবন দুই তলা প্রি–ফেব্রিকেটেড মানে ইস্পাতের তৈরি। ভবনের ছোট একটি অংশে অবশ্য তিনতলা করে সেখানে শ্রমিকদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, তিনতলার ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি রাখা হয়নি। সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। কারণ কী? ফজলে শামীম এহসান বলেন, যখনই ভালো ব্যবসা হয় তখনই বেশির ভাগ শিল্পমালিকই দ্রুত কারখানার উৎপাদনসক্ষমতা বাড়াতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন কারখানার খরচ তুলতে কম দামে পোশাকের ক্রয়াদেশ নিতে বাধ্য হোন। তাতে মুনাফা কমে যায়। মূলত কারখানা বড় করার লোভ সামলাতেই তিনতলায় ওপরে ওঠার সিঁড়ি দেওয়া হয়নি। যদিও কারখানার ভিত্তি চারতলার।

কর্মীদের কাজ দেখছেন ফতুল্লা অ্যাপারেলসের স্বত্বাধিকারী ফজলে শামীম এহসান
ছবি: প্রথম আলো

ফজলে শামীম এহসান ফতুল্লা অ্যাপারেলস গড়ে তুলেছেন ৯ বিঘা জমির ওপর। ৭০ শতাংশ জায়গা খোলা রেখে এই কারখানা ভবনের নকশা করেছেন মেহেরুন ফারজানা। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কারখানা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজ শেষে ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি উৎপাদন শুরু হয়। তার আগে ফতুল্লা অ্যাপারেলস নারায়ণগঞ্জের একটি ভাড়া ভবনে ছিল। ২০০২ সালে কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন এই উদ্যোক্তা। এর আগে তিনি বাবা-চাচাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ফতুল্লা ডায়িংয়ে বসতেন।

শ্রীলঙ্কান পরামর্শক কীর্তি রত্নায়েকের তত্ত্বাবধানে শুরু থেকে ফতুল্লা অ্যাপারেলসকে পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে গড়ে তোলেন ফজলে শামীম এহসান। তবে সনদ নেওয়ার প্রক্রিয়াটি দুই বছর বন্ধ ছিল মাঝে করোনাভাইরাসের কারণে। গত বছর আবার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৭ সেপ্টেম্বর লিড প্লাটিনাম সনদ পায় ফতুল্লা অ্যাপারেলস। সব মিলিয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানাটি নির্মাণে জমি ছাড়া ৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন ফজলে শামীম এহসান। এর মধ্যে একটি অংশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া।

কারখানা ভবনের নিচতলা ও দোতলায় টানা বারান্দা। নিচতলার এক অংশে থরে থরে কাপড় রাখা। আরেক অংশে কাটিং সেকশন। ওপরের তলায় স্যুইং সেকশন। পুরোটাই খোলামেলা। বিশাল বিশাল জানালা, তাতে কোনো গ্রিল নেই। ওপরে অল্প কিছু এলইডি বাতি লাগানো আছে। আর আছে সাধারণ সিলিং ফ্যান। তাতেই কারখানার বাইরের ও ভেতরের তাপমাত্রা সমান সমান হয়ে যায়। অত্যধিক গরমের সময় ভেতরের পরিবেশ ঠান্ডা রাখতে বিশাল আকৃতির কুলার বসানো রয়েছে।

ফজলে শামীম এহসান প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ফতুল্লা অ্যাপারেলসে পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত সব মেশিনই বিদ্যুৎসাশ্রয়ী। পোশাক তৈরির পর অপ্রয়োজনীয় সুতা কাটার জন্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বসানো হয়েছে। পোশাক আয়রন করার জন্যও কোনো গ্যাস বয়লার ব্যবহার করা হয় না। বিকল্প ব্যবস্থায় কাজটি করা হচ্ছে। আবার বাথরুমসহ অন্যান্য জায়গায় পানিসাশ্রয়ী কল লাগানো হয়েছে। কারখানার ৭৫ শতাংশ জায়গায় সূর্যের আলো পৌঁছায়। ছাদে ৬৯ কিলোওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে কারখানাটিতে ৪৮ শতাংশ কম বিদ্যুৎ খরচ হয়। বৃষ্টির পানি ব্যবহার করার কারণে অন্যান্য কারখানা থেকে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ৪০ শতাংশ কম হচ্ছে।

পরিবেশবান্ধব কারখানাটিতে শ্রমিকেরা বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধাও পান। মাস শেষ হয় ২৭ তারিখ। তারপর হিসাব-নিকাশ করে ৩ তারিখের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়। আর প্রতি তিন মাস অন্তর বিনা মূল্যে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য চেকআপ করার ব্যবস্থা করা হয়। অন্যান্য কারখানা থেকে মজুরিও কিছুটা বেশি। এসব তথ্য জানান প্রতিষ্ঠানটির মালিক।

কারখানাজুড়ে আম, পেয়ারা, লটকন, রয়েল, আমলকী, আমসহ বিভিন্ন ধরনের ফলদ ও ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। শ্রমিকেরা সেই ফল খেতে পারেন। ফজলে শামীম এহসান বললেন, লুকিয়ে গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়ার আনন্দ অনেক। নিরাপত্তাকর্মীদের সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া আছে। কেউ ফল পেড়ে খাচ্ছে দেখলে নিরাপত্তাকর্মীরা সতর্ক করেন। তবে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার করা হয় না। শাস্তি দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।

কারখানাটিতে কাজ করেন প্রায় ৫০০ শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে টি-শার্ট, জ্যাকেট, হুডি, রাতে ঘুমানোর পোশাক, স্পোর্টসওয়্যার ও বাচ্চাদের পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে ৭৫ লাখ মার্কিন ডলার আয় করেছে কারখানাটি, যা বাংলাদেশের ৭৪ কোটি ২৫ লাখের মতো। বেশি মূল্যের পোশাক তৈরি করার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘আমরা বেছে বেছে কাজ করি। ৩০০-৪০০ পিছ থেকে শুরু করে ২০ হাজার-৩০ হাজার পিছ পর্যন্ত পোশাকের ক্রয়াদেশও নিয়ে থাকি। তাতে আমাদের রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের গড় মূল্য ৮ ডলারের কাছাকাছি পড়ে।’

আলাপচারিতার একপর্যায়ে ফজলে শামীম এহসান বললেন, ‘অনেক দিন ধরেই আমি এমন এক কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা করছিলাম, যেখানে শ্রমিকেরা আনন্দ ও উচ্ছলতা নিয়ে প্রতিদিন কাজে আসবেন। তার অনেকখানি করা সম্ভব হয়েছে। মধ্যাহ্নবিরতিতে শ্রমিকেরা কারখানার বারান্দায় লুডু খেলেন। বাগানে এসে ছবি তোলেন। মন চাইলে গাছ থেকে ফল পেড়ে খান। ঈদের আগে সবাই এক নকশার পোশাক বানিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন। শ্রমিকদের এই আনন্দই আমাকে প্রশান্তি দেয়।’

পুকুরপাড়ে একটা কদমগাছ আছে। সেই গাছে প্রচুর কদমফুল ফুটেছে এবার। ফজলে শামীম এহসান জানান, কদমতলায় পুরোনো দিনের মতো একটি শানবাঁধানো ঘাট বানানো হবে। সেখানে শ্রমিকেরা এসে বসবেন। মন ভালো করা এই পরিকল্পনা শুনে রওনা দিলাম ঢাকার পথে। ততক্ষণে সূর্য উঁকি দিয়েছে পশ্চিমের আকাশে।