বাজারে দেশি ফল লটকনের ভরা মৌসুম, দরদাম কত ও পুষ্টিগুণ কী

বাজারে এসেছে দেশি ফল লটকন। বুধবার কারওয়ান বাজার থেকে তোলাছবি: প্রথম আলো

বাজারে এখন দেশি ফল লটকনের ভরা মৌসুম। প্রাচীন ফলটি দেখতে অনেকটা হলুদমতো ও আকারে ছোট। গত কয়েক বছরে এই ফল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চাষিরা এই ফল উৎপাদনে উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। ফলটি বেশ পুষ্টিগুণসম্পন্ন। এই বর্ষায় ফ্লু, জ্বর, সর্দি, কাশির সংক্রমণ রোধে ভালো কাজ করে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী নরসিংদী জেলায় সারা দেশের লটকনের অর্ধেকের বেশি ফলন হয়।

দাম কত

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গতবারের তুলনায় এবার লটকনের দাম বেশি। ঢাকায় এবার প্রতি কেজি লটকন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। কোথাও কোথাও তার চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ গতবার একই সময়ে লটকনের দাম ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এবার চৈত্র মৌসুমে খরা বেশি থাকায় গাছে ফলন কম এসেছে। আর সরবরাহ কম থাকায় দামও বাড়তি।

গত বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার গিয়ে দেখা গেছে, প্রতি কেজি লটকন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। বিক্রেতা মো. জাকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত কয়েক দিনের বৃষ্টির কারণে দাম কিছুটা কম। অন্য সময় ২০০ থেকে ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি করি।’ দাম বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে এ বিক্রেতা জানান, পাইকারিতে তাঁদের কিনতে হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি দরে। ২০ থেকে ২৫ দিন আগে বাজারে আসা লটকন আরও মাসখানেক পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।

মূলত সরবরাহ কম থাকায় দাম বেশি বলছেন আরেক বিক্রেতা আরমান মিয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দাম কমার সম্ভাবনা কম; বরং বৃষ্টি কমলে দাম আরও বাড়বে। কারণ, তখন বাজারে ক্রেতাও বাড়বে।

কারওয়ান বাজারের চারটি দোকানে নরসিংদীর লটকন বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য হলো নরসিংদীর লটকন মিষ্টি। তাই বিক্রি ভালো। কিন্তু অন্য এলাকাগুলোর লটকন এতটা মিষ্টি না।

এবার ফলন কম কেন

লটকনের ফলন এবার প্রায় অর্ধেকে নেমেছে বলে জানান নরসিংদীর শিবপুরের লটকনচাষি আনোয়ার হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গতবার এই সময়ে স্থানীয় বাজারে যে পরিমাণ লটকন ছিল, এবার তার অর্ধেক। আর এখনকার বৃষ্টিতে লটকন ঝরে যাচ্ছে। ওষুধ দেওয়া যায় না, তাই পোকায় লটকন নষ্ট করে ফেলছে। তবে ফলন কম হওয়ায় এবার দাম ভালো। গতবার ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এবার ২০০ টাকার ওপরে দাম পাওয়া যাচ্ছে।

এবার ফলন কম হওয়ার কারণ নিয়ে কথা হয় নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) সুব্রত কান্তি দত্তের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবারের চৈত্র মাসে খরার বেশ প্রকোপ ছিল। তাই ফলন কিছুটা কম হয়েছে। আর ফলন কম হওয়া লটকন পরিপূর্ণ আকৃতির হয়েছে। তাই এবার লটকন আকারে বড় হয়েছে। ফলে এবার চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন।’ দেড় মাস আগে মৌসুম শুরু হয়ে এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।

ফলন কম হলেও এবার কৃষকের তুলনায় ফড়িয়াদের ব্যবসা ভালো বলছেন আবাদকারীরা। কারণ, গতবারের দামের মতোই দাম ধরে তাঁরা বাগানে লটকন বিক্রি করছিলেন, কিন্তু ফড়িয়ারা এখন তা দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন।

নরসিংদীর শিবপুর লটকনের সবচেয়ে বড় উৎপাদনস্থল। উপজেলার নৌকাঘাটের ছোটন মিয়া নিজের জমিতে লটকন চাষ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতবার প্রায় ১২ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করেছি। এবার ফলন কম হওয়ায় ৮ লাখ টাকা বিক্রি করতে পেরেছি। তবে ফড়িয়ারা বেশি ব্যবসা করতে পারছেন। কারণ, আমরা প্রতি মণ ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। কিন্তু তারা (ফড়িয়া) ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন।’

বাজারে এসেছে দেশি ফল লটকন। বুধবার কারওয়ান বাজার থেকে তোলা
ছবি : প্রথম আলো

কয়েক বছরে আবাদ বাড়ছে

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের ৩ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমিতে লটকনের আবাদ হয়েছিল। আর ফলন হয়েছিল ৪০ হাজার ১২০ মেট্রিক টন। আর এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাদের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১২৭ হেক্টর। ফলন হয়েছিল ৩৮ হাজার ৮৬২ মেট্রিক টন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে লটকনের আবার হয়েছিল ২ হাজার ৯৬৭ হেক্টর। সে বছর ফলন ছিল ৩৭ হাজার ৯১৪ মেট্রিক টন। অর্থাৎ প্রতিবছর ফলন ও আবাদের পরিমাণ বাড়ছে। তবে এবার ফলন কিছুটা কম হবে বলছেন কর্মকর্তারা।

এখন প্রতিবছরই বাড়ছে বাগানের সংখ্যা। অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ায় এ অঞ্চলের চাষিরা ঝুঁকে পড়ছেন লটকন চাষের প্রতি। এসব অঞ্চলের লটকন এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এতে করে এসব অঞ্চলের চাষিদের ভাগ্য বদলে যাচ্ছে।

পুষ্টিগুণ কী, কেন খাবেন

লটকন শুধু অম্লমধুর ফল নয়, খাদ্যমানেও পুষ্টিগুণসম্পন্ন। লটকনে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, জিংক, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি ইত্যাদি এবং প্রোটিন ও প্রচুর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ও রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণও বাড়বে। বর্ষায় ফ্লু, জ্বর, সর্দি, কাশির সংক্রমণ হতে পারে। নিয়মিত লটকন খেলে এসব সংক্রমণজনিত রোগ প্রতিরোধ হয়।

লটকন কোথায় হয়

লটকন বাংলাদেশের অতি সুপরিচিত ও প্রাচীন ফল। তবে আগে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হতো না। ফলটি গোলাকার ও পাকা অবস্থায় হলুদ দেখা যায়। ফলের খোসা নরম ও পুরু। প্রতি ফলে তিনটি করে বীজ থাকে। উৎপাদনের পরিমাণ বেশি না হলেও দেশের সব এলাকাতেই কমবেশি এটা চাষ হয়। তবে নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নেত্রকোনা ও সিলেট এলাকায় এখন বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষ হয় বেশি। সাধারণত শীতের শেষে গাছে ফুল আসে। আর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ফল পাকে। নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্যমতে, জেলায় গত অর্থবছরে লটকনের আবাদ হয়েছিল ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। যা দেশের লটকন আবাদের মোট জমির অর্ধেকের বেশি। আর গড় ফলন ছিল প্রতি হেক্টরে ২ মেট্রিক টন। অর্থাৎ মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন।

উঁচু আর লাল মাটির টিলা লটকন চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বেলে ও দোআঁশ মাটি সব থেকে উপযোগী। তাই নরসিংদী ও গাজীপুরের লাল মাটির এলাকায় আগে থেকেই লটকন চাষ করা হতো। লটকন চাষে রোগবালাইয়ের তেমন একটা ঝামেলা নেই এবং খরচও কম। রোপণের চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই ফলন আসে। আর ফল দেয় টানা ২০ থেকে ৩০ বছর। তা ছাড়া লটকন বিক্রি নিয়েও কোনো ঝামেলা নেই। কারণ, পাইকারেরা বাগান থেকেই লটকন কিনে নিয়ে যান।