বাজেট: এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমছে, শিক্ষায় তেমন বাড়ছে না

বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নানা ধরনের শর্ত ও পরামর্শ দিয়েছে। এগুলোর অন্যতম পরামর্শ হলো, প্রয়োজনে ভর্তুকি কমিয়ে সেই অর্থে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব বোঝাতে এমন পরামর্শের কথা তারা বলেছে। তবে আগামী বাজেটে এর প্রতিফলন দেখা যাবে না, উল্টো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরাদ্দ কমছে বলে জানা গেছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়লেও স্বাস্থ্য বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ কমছে। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং পরিবহন ও যোগাযোগ—এ দুই খাতের মোট এডিপির প্রায় ৪৬ শতাংশ বরাদ্দ যাচ্ছে।

আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার হতে যাচ্ছে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল এডিপি হবে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। মূল এডিপিতে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ বাদ দেওয়া হয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় নতুন এডিপি প্রস্তাব আকারে চূড়ান্ত করেছে। আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় নতুন এডিপি পাস হবে। ওই সভায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপি উত্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন। সভায় প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য সদস্যরা চাইলে বরাদ্দ কমবেশি করার সুযোগ আছে।

স্বাস্থ্য খাতে কম বরাদ্দ

প্রস্তাবিত এডিপিতে দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলোর জন্য সব মিলিয়ে ১৬ হাজার ২০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। চলতি এডিপি প্রণয়নের সময় এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৯ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এ বছর বরাদ্দ কমছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে শিক্ষা খাতে ৮০০ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ বেড়েছে। এ খাতে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে ২৯ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে কম খরচ করে বাংলাদেশ। এখন শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ শতাংশের মতো খরচ করা হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য খাতে তা ১ শতাংশের কম। অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করছেন।

সামাজিক সুরক্ষায় কমছে ২৮৬ কোটি টাকা

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। প্রকৃত আয় কমে গেছে। আগামী বাজেটে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়বে, এমন প্রত্যাশা সবার। অর্থনীতিবিদেরাও তাই পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আগামী এডিপিতে এই খাতে উল্টো বরাদ্দ কমছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী এডিপিতে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৩ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে, যা চলতি সংশোধিত এডিপি থেকে ২৮৬ কোটি টাকা কম। এই খাতে এ বছর বরাদ্দ আছে ৩ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা।

সাবেক সচিব ও বড় অবকাঠামোবিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবন ধারণে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আগামী এডিপিতে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ কমানো হলে এসব মানুষ আরও অসহায় হয়ে পড়বেন। অবশ্যই এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।

তবে থোক বরাদ্দ বাড়ছে এক হাজার কোটি টাকা। বিশেষ প্রয়োজনে খরচ করার জন্য এই বরাদ্দ রাখা হয়। আগামী এডিপিতে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৪ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। চলতি এডিপিতে এর পরিমাণ ৩ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা।

দুই খাতেই অর্ধেক বরাদ্দ

এবারের প্রস্তাবিত এডিপি ঘেঁটে দেখা গেছে, শুধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং পরিবহন ও যোগাযোগ—এ দুই খাত মোট এডিপির প্রায় ৪৬ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে। এর মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা পাচ্ছে, যা মোট এডিপির প্রায় ২৯ শতাংশ। আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রায় ৪৪ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা বা প্রায় ১৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।

এ দুটি খাতে প্রায় সোয়া তিন শ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চলতি এডিপিতে এই দুই খাতে ৪৪ শতাংশ বরাদ্দ আছে। আগামী বছর তা আরও বাড়ছে।

এডিপির আকার বৃদ্ধিতে টান

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকার এডিপি নেওয়া হচ্ছে। এটি চলতি এডিপি থেকে ১৮ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা বা ৭ শতাংশ বেশি। চলতি এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা।

অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি সংশোধিত হয়ে বাড়ছে ১৬ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ফলে গত তিন বছরের মধ্যে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে কম বাড়ছে আগামী এডিপি। আগের দুবারই এডিপির আকার বেড়েছিল ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

করোনার আগের বছরগুলোয় প্রতিবারই এডিপির আকার আগেরবারের চেয়ে ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কিন্তু এখন কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় এডিপির আকার খুব বেশি বাড়ানো যাচ্ছে না বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকার ব্যয়সাশ্রয়ী পদক্ষেপও নিয়েছে। প্রকল্প অনুমোদনে নানা ধাপ পেরোতে হচ্ছে, যাচাই–বাছাই প্রক্রিয়া আরও কঠোর করা হয়েছে।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব আদায়ের গতি কমেছে। কাঙ্ক্ষিত হারে শুল্ক-কর আদায় হচ্ছে না। তাই এডিপিও আগের মতো বাড়ানো যাচ্ছে না।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী এডিপিতে স্থানীয় মুদ্রায় জোগান দেওয়া হবে ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি সহায়তা হিসেবে ৯৪ হাজার কোটি টাকা মিলবে। এ ছাড়া এডিপিতে প্রায় দেড় হাজারের মতো প্রকল্প থাকছে। এডিপি বইয়ে অনুমোদনের জন্য প্রতিবারের মতো এবারও অর্ধশতাধিক সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি প্রকল্প থাকছে।