বন্দর পরিচালনার নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ, চুক্তি বুধবার

চট্টগ্রাম বন্দরফাইল ছবি

২৬ বছর আগে ১৯৯৭ সালের ৩ জুলাই বন্দর পরিচালনায় নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল ভারত। সেদিন দেশটির জওহরলাল নেহরু বন্দরের একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার চুক্তি হয়। এরপরের গল্প বন্দর খাতে ভারতের বেসরকারীকরণ আর বিশ্বমানে উন্নীত হওয়ার। একই বছরে পাকিস্তানও তাদের কাসিম বন্দরের একটি কনটেইনার টার্মিনাল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েছিল। দুই দেশের বন্দর বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি বিনিময়।

ভারত-পাকিস্তানের ২৬ বছর পর এবার বাংলাদেশও একই পথে হাঁটছে। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিদেশি কোম্পানির হাতে দীর্ঘ মেয়াদে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল পরিচালনার ভার দিতে চলেছে। ভারত-পাকিস্তানের প্রথম টার্মিনাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল বৈশ্বিক বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ‌‌পিঅ্যান্ডও পোর্টসের হাতে, যেটি ২০০৬ সালে ডিপি ওয়ার্ল্ড অধিগ্রহণ করে। বাংলাদেশ অবশ্য সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের হাতে একটি টার্মিনাল পরিচালনার ভার তুলে দিচ্ছে। নানা প্রক্রিয়া ও দর-কষাকষি শেষে কাল বুধবার (৬ নভেম্বর) এ-সংক্রান্ত ‘কনসেশন’ চুক্তি হওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে।

জানা গেছে, সৌদি কোম্পানিকে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে। বন্দরের মূল জেটির ভাটিতে বোটক্লাবের পাশে অবস্থিত টার্মিনালটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ নভেম্বর উদ্বোধন করেন। টার্মিনালটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠানটি এই টার্মিনালে যন্ত্রপাতি খাতে বিনিয়োগ করে পরিচালনা করবে। টার্মিনালে জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার নামিয়ে চত্বরে রাখা; রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে তোলা; কনটেইনার সংরক্ষণ, স্থানান্তর ও তা খুলে পণ্য খালাস ইত্যাদি কাজ হয়ে থাকে। এসব ব্যবস্থাপনা বাবদ অর্থ আদায় করবে তারা, যা বন্দরের সঙ্গে ভাগাভাগি হবে।

বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় সৌদি প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে জিটুজি ভিত্তিতে চুক্তি হবে। সরবরাহ, পরিচালনা ও হস্তান্তর ভিত্তিতে ২২ বছর মেয়াদে টার্মিনালটি পরিচালনা করবে কোম্পানিটি। চুক্তির পর এককালীন ও বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথা বন্দরকে। এ ছাড়া সৌদি কোম্পানি কনটেইনার ওঠানো-নামানোর জন্য শিপিং কোম্পানি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে ফি পাবে, তা থেকে কনটেইনারপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বন্দরকে দেওয়ার কথা। এই ফি কত, তা এখনো প্রকাশ করেনি বন্দর।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, আগামীকাল বুধবার (৬ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চুক্তি হবে। চুক্তি হওয়ার পর বিষয়গুলো জানানো হবে। শুরুতে সৌদি কোম্পানিটি জাহাজের ক্রেন দিয়ে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজ করবে। দ্রুত ছোটখাটো যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হবে। তবে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর গ্যান্ট্রি ক্রেন সংযোজন করে কার্যক্রম পুরোদমে চালু করতে তাঁদের কিছুটা সময় লাগতে পারে।

পতেঙ্গা টার্মিনালটি চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরে টার্মিনালের সংখ্যা চারটিতে উন্নীত হবে। পুরোনো জিসিবি, সিসিটি ও এনসিটি—এই তিন টার্মিনালে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোই ছিল এত দিন মূল ভরসা। সারা দেশে আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের ৯৮ শতাংশই এই তিন টার্মিনাল দিয়ে ওঠানো-নামানো হতো। নতুন টার্মিনাল চালু হলে ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সুবিধা বাড়বে।

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বন্দর খাতে বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার উদ্যোগ খুবই ভালো। এতে যেমন বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, তেমনি সেবার মান নিয়েও প্রতিযোগিতা বাড়বে। ফলে বেসরকারি খাত উপকৃত হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর এত দিন পরিচালনা হয়ে আসছে ‘টুলপোর্ট’ মডেলে। এই মডেলে বন্দর কর্তৃপক্ষ সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনা করছে। সব ধরনের মাশুলও আদায় করছে বন্দর। শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজের বিনিময়ে দরপত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট অর্থ দেওয়া হয়।  

পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনার ভার বেসরকারি খাতে দিয়ে এবার ‘ল্যান্ডলর্ড’ মডেলে পা রাখবে বন্দর। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘পোর্ট রিফর্ম টুলকিট’ শীর্ষক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, বড় ও মাঝারি আকারের বন্দর পরিচালনায় সবচেয়ে প্রভাবশালী মডেল হলো ল্যান্ডলর্ড।  

পতেঙ্গা টার্মিনাল বাংলাদেশে প্রথম বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনায় নাম লেখালেও এটিই এ ধরনের প্রথম উদ্যোগ নয়। এক যুগ আগে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সে সময় বিশ্বখ্যাত চারটি প্রতিষ্ঠান হাচিসন পোর্ট ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ডিপি ওয়ার্ল্ড, এপিএম টার্মিনালস এবং ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার সার্ভিসেসকে দরপত্রে অংশ নেওয়ার যোগ্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল। অবশ্য পরে উদ্যোগটি ভেস্তে যায়।

আবার পতেঙ্গা টার্মিনালের আগে বেসরকারি খাতে বন্দরের টার্মিনাল উন্নয়ন ও পরিচালনার ভার ছেড়ে দেওয়ার নজির আছে মোংলা বন্দরে। সেটি অবশ্য বিদেশি প্রতিষ্ঠান নয়। ২০১৬ সালে দেশীয় প্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক পোর্টস লিমিটেডের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় মোংলা বন্দরের দুটি জেটি নির্মাণ ও পরিচালনায় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হয়। অবশ্য ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাইফ পোর্ট হোল্ডিংস লিমিটেড এই চুক্তিতে যুক্ত হয়। সাইফ পোর্ট হোল্ডিংস এই দুটি জেটি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে চালু করার কথা জানিয়েছে।  

বিদেশি অপারেটরকে কীভাবে দেখছেন, জিজ্ঞেস করা হলে দেশের একমাত্র টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। তবে বিদেশিদের পাশাপাশি দেশীয় প্রতিষ্ঠানকেও নতুন নতুন টার্মিনাল পরিচালনার ভার ছেড়ে দেওয়া উচিত। এতে দুটি লাভ হবে। এক, টার্মিনাল পরিচালনায় প্রতিযোগিতা বাড়বে। দুই, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অভিজ্ঞতা অর্জন করে বিদেশেও বন্দর পরিচালনার সাহস পাবে।

ভারতীয় ও পাকিস্তানি বন্দরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, দুই দেশেই বেসরকারি খাতের মাধ্যমে নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার কাজ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ভারতের প্রধান বন্দরগুলোর ৩২টির বেশি টার্মিনাল এখন পরিচালনা করছে বেসরকারি খাত। এর বাইরে সাগরমালাসহ নানা প্রকল্পে তিন শতাধিক সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি প্রকল্প হাতে নিয়েছে দেশটি। অন্যদিকে পাকিস্তানের পাঁচটি টার্মিনাল রয়েছে বেসরকারি খাতে। ভারতে শুরুতে বিদেশি অপারেটরের হাতে টার্মিনাল ছেড়ে দেওয়া হলেও এখন তাদের দেশেও আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল অপারেটর তৈরি হয়েছে।