আমদানিনির্ভর বহু প্রকল্প সরকার এখনই বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী নয়। ডলারের চাপ সামলাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য এমন ৮১টি প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সবচেয়ে কম অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে এসব প্রকল্প বাঁচিয়ে রাখা হবে।

কম অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায় রাজধানী ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হেলিপোর্ট, বরিশাল ও সৈয়দপুর বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, ফায়ার সার্ভিসের যন্ত্রপাতি কেনা, দেশের সব উপজেলায় এলইডি ডিসপ্লে স্থাপন, আইটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণ ইত্যাদি। এই তালিকায় আরও আছে খুলনায় কর ভবন ও নরসিংদীতে কারাগার, নারায়ণগঞ্জে দোতলা সড়ক নির্মাণ ও শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাত করার প্রকল্পও।

তবে সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, উপজেলা ও ইউনিয়নে ভূমি অফিস নির্মাণ, প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন এবং শেরপুর ও নাটোরে সড়ক চওড়া করা ও সড়ক বিভাজক নির্মাণের মতো প্রকল্প অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে।

বর্তমানে এডিপিতে ১ হাজার ৩৬৩টি প্রকল্প আছে। অর্থনীতির এই চাপের সময়ে সরকার সম্প্রতি এই প্রকল্পগুলোকে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ শ্রেণিতে ভাগ করেছে। ৬৪৬টি প্রকল্প ‘এ’ শ্রেণিতে, ৬৩৬টি প্রকল্প ‘বি’ শ্রেণিতে এবং ৮১টি প্রকল্প ‘সি’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে।

‘এ’ শ্রেণির প্রকল্পকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে। এর মানে, চলতি এডিপিতে যা বরাদ্দ আছে, তা পুরোটাই খরচ করবে। ‘বি’ শ্রেণিতে থাকা প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ (দেশজ উৎসের অর্থ) ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। ‘সি’ শ্রেণির প্রকল্পকে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হবে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের চাপ সামলাতে যেসব প্রকল্পে আমদানির উপাদান আছে, ওই সব প্রকল্পের (এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন না করলেও চলে) রাশ টেনে ধরা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো বাতিল করা হয়নি। পরে বাস্তবায়ন করা হবে।

আপাতত ব্যয়ের চাপ থেকে একটু স্বস্তি দিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখে এমন প্রকল্প অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। অফিস-আদালত (ভবন) নির্মাণের মতো প্রকল্প ছয় মাস পিছিয়ে দিলেও সমস্যা নেই।

ভবন নির্মাণ ও সড়ক বিভাজকের প্রকল্পে উচ্চ অগ্রাধিকার

সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া ‘এ’ শ্রেণিতে থাকা ৬৪৬টি প্রকল্পের মধ্যে ভবন নির্মাণ, সড়ক বিভাজক, নদী খনন, প্রশিক্ষণকেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণ করা প্রকল্পও আছে। এই প্রকল্পগুলোর খরচ কিছুটা কমিয়ে সরকারি অর্থ সাশ্রয় করা যেত। কিন্তু অর্থনীতির এই চাপের সময়ে সরকারের সবচেয়ে অগ্রাধিকারের তালিকায় এমন কিছু প্রকল্প ঢুকে গেছে।

সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে ২৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত আছে। যখন সরকারি খরচ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্প সরকারের সবচেয়ে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে ‘এ’ শ্রেণির তালিকায় রাখা হয়েছে। জানা গেছে, এই প্রকল্পে প্রায় ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে।

দেশের প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়নে ভূমি অফিস নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জন্য ৭১৫ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। গত জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ৭০ শতাংশের মতো বাস্তবায়িত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রায় ১৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই ভবন নির্মাণের প্রকল্পও সরকারের উচ্চ অগ্রাধিকারে আছে।

একইভাবে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনে প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এই প্রকল্পে খরচ করা হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে প্রকল্পটি শেষ হবে। চলতি অর্থবছরে ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখে এই প্রকল্পের বরাদ্দের পুরোটা খরচের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

শেরপুর ও নাটোরে সড়ক চওড়া করা ও সড়ক বিভাজক নির্মাণের প্রকল্পও ঢুকে গেছে উচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায়। শেরপুর জেলার একটি সড়ক চওড়া করা হবে। জেলার আখেরবাজার-লঙ্গরপাড়া-শ্রীবরদী (মামদামার) পথে এই অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। এতে খরচ হবে ১০০ কোটি টাকা। আবার নাটোর জেলার এমন আরেকটি প্রকল্প আছে। নাটোর সদরের হরিশপুর বাইপাস থেকে বনবেলঘরিয়া বাইপাস মোড় পর্যন্ত এই সড়কে বিভাজক নির্মাণ ও প্রশস্ত করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে খরচ হবে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের সঞ্চয়ের জন্য এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন না করলেও চলবে—এমন আমদানিনির্ভর প্রকল্পের গতি কমানোর সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। ‘এ’ শ্রেণিতে থাকা অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলো হয়তো কর্মসংস্থানের স্বার্থে রাখা হয়েছে। তবে ওই সব প্রকল্পে খরচ কমানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু খরচ কমানোর সিদ্ধান্ত যিনি নেবেন, অনেক ক্ষেত্রে তিনি এর সুবিধাভোগী। তাই শুধু ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ শ্রেণিতে ভাগ না করে খরচ কোথায় কত কমানো হবে—এর বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা হওয়া দরকার।

খরচ বাঁচবে এডিপির ১০-১৫%

চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের অগ্রাধিকার ভেদে বিদেশ ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণ, বৈঠক ভাতা, আপ্যায়ন, গাড়ি কেনা, স্টেশনারি সামগ্রী, জ্বালানি তেল—এসব খাতে বরাদ্দ করা খরচ ৫০ শতাংশ কমানোর নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের প্রকল্পে এসব খাতে খরচ সীমিত করেছে।

যেমন প্রতি গাড়িতে জ্বালানি তেল বাবদ প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ১৬০ লিটার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অনলাইনে বৈঠকে উৎসাহিত করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন না হলে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এসব কারণে চলতি অর্থবছরে এডিপির ১০-১৫ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় হবে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ২৫ থকে ৩০ হাজার কোটি টাকা।

সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ফেরত

বিদায়ী অর্থবছরের মে মাসে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করা হয়। জরুরি প্রয়োজন না হলে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। আর বৈঠক ভাতাসহ সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্র সাধন করা হয়। গত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পেও খরচে নিরুৎসাহিত করা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরের শেষ দিকে করা এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ কমানোর নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।