এক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতি-অর্থনীতির প্রায় সব হিসাব বদলে যাচ্ছে। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার মূল জায়গা হচ্ছে রাশিয়ার জ্বালানি। কারণটা সবাই জানেন, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে রাশিয়া। ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। এই গ্যাস দিয়ে তাদের শিল্পকারখানা পরিচালিত হয়, সেই সঙ্গে শীতকালে ঘর গরম রাখতে গ্যাসের বিকল্প নেই। কাজেই রাশিয়ার জ্বালানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইউরোপ ভালোরকম বিপদে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যুক্তরাজ্যের। দেশটিতে তেল-গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, অনেক মানুষ জ্বালানি দারিদ্র্যের কবলে পড়বে। আসন্ন শীতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তখন সে দেশে পরিবারের বার্ষিক জ্বালানি ব্যয় দাঁড়াতে পারে ৪ হাজার পাউন্ড। এই পরিস্থিতিতে প্রমাদ গুনছেন দেশটির নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
এখন কথা হচ্ছে, ইউরোপ কি রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া চলতে পারবে? এই প্রশ্নের এককথায় উত্তর দেওয়া বোধ হয় এখন সম্ভব নয়। কারণ, বিকল্প উৎস তৈরি করা ছাড়া ইউরোপের চলা সম্ভব নয়, এ কথা বলাই বাহুল্য। তবে যারা পৃথিবীতে নানাভাবে ছড়ি ঘোরায়, তারা একদম আগুপিছু না ভেবে রাশিয়ার গ্যাস না নেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটাও সম্ভবত ঠিক নয়।
এই বাস্তবতায় ইউরোপের দেশগুলো এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের দিকে ঝুঁকছে। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই এলএনজির দাম বাড়ছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের স্থানীয় বাজারেও আগামী কয়েক বছরে এলএনজির চাহিদা বাড়বে। এ কারণে জ্বালানি তেল উত্তোলনে বিশ্বের শীর্ষতম অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিপুল বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
এলএনজি রপ্তানির বাজারে মধ্যপ্রাচ্যে নেতৃত্ব দেয় কাতার। সে তুলনায় এ অঞ্চলের জ্বালানি সম্পদ সমৃদ্ধ অন্য দেশগুলো গ্যাসের বাজারে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল। এবার সেই দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। ওপেক জোটের প্রভাবশালী দুই সদস্য—সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতে বড় কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে ওপেক প্লাস জোটের সদস্য—ওমান নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও পুরোনোগুলোতে উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকেই বিনিয়োগ বাড়ানোর এই তোড়জোড়।
রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে গ্যাসের বিকল্প উৎস খুঁজছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরই অংশ হিসেবে সে অঞ্চলের গ্যাস ব্যবসায়ীরা আগামী গ্রীষ্ম আসার আগেই পর্যাপ্ত এলএনজি বা তরল গ্যাসের উৎস খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপে রাশিয়ার বিকল্প খোঁজার উন্মাদনায় ইতিমধ্যে এলএনজি ক্যারিয়ারের যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা শিগগিরই শেষ হবে বলে মনে হয় না। একটি নতুন এলএনজি ক্যারিয়ার তৈরি হতে সময় লাগে কয়েক বছর। সেই সঙ্গে, ইউরোপ যে হঠাৎ কয়েক মাসের মধ্যে মার্কিন তরলীকৃত গ্যাসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হয়ে উঠবে, তা কেউ–ই বুঝতে পারেনি। তাই বৈশ্বিক জ্বালানির চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ইতিমধ্যে যে ব্যবধান দেখা দিয়েছে, তা নিকট ভবিষ্যতে আরও গভীর হতে পারে।
এই বাস্তবতায় স্পট মার্কেট থেকে বেশি বেশি এলএনজি কেনার কারণে সেখানে দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ যে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে, তা মূলত এ কারণেই। গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে এলএনজি ক্রেতা দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে ফিরছে। এর মাধ্যমে তারা এলএনজি স্পট বাজারের অস্থিতিশীল মূল্য থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এলএনজির প্রচলিত ইউরোপীয় ক্রেতারা এখন স্পট বাজার থেকে কিনবে না। আবার রুশ এলএনজি বিক্রেতাদের সঙ্গেও বর্তমান চুক্তি নবায়ন করবে না। ফলে তারা (মধ্যপ্রাচ্য ও অন্য উৎস থেকে) দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির দিকে ঝুঁকবে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান উৎপাদক দেশগুলো তেল ও গ্যাস বিক্রির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতেই আগ্রহী; বাজার চাঙা থাকলে চলতি দশকের শেষ নাগাদ তারা বৈশ্বিক এলএনজি রপ্তানিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে চায়।
এলএনজির আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা পূরণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে কাতার। পারস্য উপসাগরীয় অন্য দেশগুলোও গ্যাস উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য এলএনজি অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করছে। তারা শুধু রপ্তানি বাজার লক্ষ্য করেই এসব করছে তা নয়; নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতেও তেল পোড়ানো কমাতে চায় তারা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সে জায়গায় গ্যাসের পরিমাণ বাড়লে সাশ্রয় হওয়া ক্রুড বা অপরিশোধিত তেল তারা রপ্তানি করতে পারবে, এমনটাই পরিকল্পনা।
কানাডার উত্থান
বিশ্বে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনে শীর্ষ ছয়টি দেশের মধ্যে কানাডা অন্যতম। শীর্ষস্থানে কিন্তু রাশিয়া নয়, আছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া দ্বিতীয়। তবে ভৌগোলিক নৈকট্য ও ঐতিহাসিক নানা কারণে রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোপের গ্যাস নেওয়া সহজ। এত দিন তা–ই হয়ে আসছে। তবে যুদ্ধের এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় এখন কানাডার নামও সামনে চলে আসছে। তারা এখন ইউরোপের কৌশলগত মিত্রদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। স্বয়ং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আল–জাজিরাকে বলেছেন, জার্মানির সঙ্গে এলএনজি রপ্তানির বিষয়ে কানাডার আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘স্বল্প মেয়াদে বৈশ্বিক গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধিতে আমরা সক্ষমতা বৃদ্ধি করব, অর্থাৎ সরাসরি ইউরোপে এলএনজি রপ্তানি করা যায় কি না, তার পথ খুঁজে দেখব’।
তবে কাজটা যে এত সহজ নয়, জাস্টিন ট্রুডো তা জানেন। প্রাথমিকভাবে এলএনজির অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করতে হবে। সমস্যা আছে নানাবিধ। ট্রুডো বলেন, ‘এলএনজি রূপান্তর কারখানা সাধারণত তার উৎসের কাছাকাছি স্থাপন করা হয়। সমস্যা হচ্ছে, জার্মানিতে এলএনজি রপ্তানি করতে আমাদের পূর্ব উপকূলে কারখানা করতে হবে। আর আমাদের গ্যাস কারখানাগুলো পশ্চিম কানাডায়।’
অবশ্য কাজটি একদম অসাধ্য মনে করছেন না জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, ‘পূর্ব উপকূলে ইতিমধ্যে আমাদের কিছু অবকাঠামো আছে। আমরাও চেষ্টা করছি, কীভাবে সবচেয়ে কাজের কাজটা করা যায়, তার উপায় খুঁজছি। এ মুহূর্তে আমরা যেটা করতে পারি তা হলো, আমাদের গ্যাস বিশ্ববাজারে ছেড়ে দেওয়া, তখন জার্মানি ও ইউরোপ অন্যান্য উৎস থেকে তা খুঁজে নিতে পারবে’।
গ্যাসের পাশাপাশি কানাডার আলবার্টা প্রদেশে বিপুল পরিমাণ তেল উৎপাদিত হয়। তারা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম তেল উৎপাদক। এ বছরের শুরুতে তারা ইউরোপকে সহায়তা করতে তেল ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলেছিল। এখন তারা কার্যত সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছে। মূলত কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ভর করেই রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে চাচ্ছে ইউরোপ।
অন্যদিকে জ্বালানি বহুমুখীকরণের চেষ্টা করছে জার্মানি। সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের এ–বিষয়ক চুক্তি হয়েছে। কানাডা থেকে জার্মানি গ্রিন হাইড্রোজেন কিনবে। শলৎজ ও জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, জার্মানি কানাডা থেকে লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাসও (এলএনজি) কিনতে চায়।
বিশ্লেষকেরা বলছে, বিশ্ববাজারে এলএনজির এই চাহিদা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। উন্নত ও শক্তিশালী দেশগুলো যখন বাজারে এলএনজির জন্য লড়াই করবে, তখন বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি সংগ্রহ করা কঠিন। সে জন্য তাদের পরামর্শ, কাতারসহ অন্যান্য এলএনজি উৎপাদকদের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তি করা উচিত।
এলএনজির বাজারে রাশিয়া
করোনা মহামারির প্রথম বছরে অর্থাৎ ২০২০ সাল থেকে রাশিয়াও এলএনজি বাজারে নিজেদের হিস্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম জ্বালানি কোম্পানি নোভাটেকের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠানটি এলএনজির বার্ষিক উৎপাদন সর্বোচ্চ ৭ কোটি টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বর্তমানে এলএনজির বিশ্ববাজারে রাশিয়ার বাজার হিস্যা ১০ শতাংশের নিচে; ২০২৫ সালের মধ্যে তা ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে চায় দেশটি।
রাশিয়ার আয় বৃদ্ধি
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্বালানি রপ্তানি করে চলতি বছর রাশিয়া ৩৩ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার আয় করতে পারে, যা গত বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি। বেশি তেল রপ্তানির পাশাপাশি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রাশিয়ার এই মুনাফা হতে পারে বলে পূর্বাভাস।
পশ্চিমাদের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার পর ধীরে ধীরে তেল উৎপাদন বাড়াতে শুরু করেছে রাশিয়া। ২০২৫ সাল পর্যন্ত তেল উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়বে বলে মনে করছে তারা। এশিয়ার ক্রেতারা তেল কেনা বাড়িয়েছে।
রুশ কোম্পানি গাজপ্রম চীনে গ্যাস রপ্তানি বাড়ানোর কথা জানিয়েছে। ভারত আগেই রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বাড়িয়েছে। বাংলাদেশও রাশিয়া থেকে তেল আমদানির বিষয় পর্যালোচনা করছে।
রয়টার্সের পূর্বাভাস, এ বছর গ্যাসের রপ্তানিমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি হাজার ঘনমিটার ৭৩০ ডলার হতে পারে, যেখান থেকে তাদের আয় বাড়বে।
গত বছর বৈশ্বিক এলএনজি আমদানি-রপ্তানির মোট পরিমাণ ছিল ৩৭ কোটি ২৩ লাখ টন, ২০২০ সালের তুলনায় যা ১ কোটি ৬২ লাখ টন বেশি। ২০২০ সালে বৈশ্বিক এলএনজি শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এ সময় শিল্প খাত স্থবির হয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।