জুনের মধ্যে রিজার্ভ বাড়বে ৫৪০ কোটি ডলার, কীভাবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতিতে গণনা করে, সে অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩ হাজার ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, রিজার্ভের চেয়ে ৮১০ কোটি ডলার কম। অর্থাৎ ২ হাজার ৪২০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবকে ভিত্তি ধরলে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষে অর্থাৎ আগামী জুনের মধ্যে এ রিজার্ভ বেড়ে অন্তত ৩ হাজার ৭৭০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ বাড়বে ৫৪০ কোটি ডলার।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে গত ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের বৈঠকে এমন অনুমানই করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ।
তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সময় এ বছরের জুনে রিজার্ভ ৪ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার হবে বলে ধরে নিয়েছিল অর্থ বিভাগ। তখন অনুমান করা হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হবে ২০ শতাংশ, প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি হবে ১৬ শতাংশ আর আমদানি প্রবৃদ্ধি হবে ১২ শতাংশ।
ডিসেম্বরে ওই প্রাক্কলন থেকে সরে এসে অর্থ বিভাগ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ১০ শতাংশ, প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ৪ শতাংশ ও আমদানির ৯ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি কমায় দেশে কত ডলার কম আসবে এবং আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক নির্ধারণ করায় কত ডলার কম খরচ হবে, সে নিয়ে অবশ্য অর্থ বিভাগ আলাদা হিসাব করেনি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগামী জুন পর্যন্ত রিজার্ভের যে প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ, তা অবাস্তব। যখন চলতি হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছে বা সময়মতো পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না ও ভাবমূর্তির অবনতি হচ্ছে, তখন এমন কোনো পদক্ষেপ সরকার নিতে পারেনি যে রিজার্ভ ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলার বেড়ে যাবে।
সরকার তো আশাবাদী হতেই পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে জাহিদ হোসেন বলেন, প্রাক্কলন করতে হয় বাস্তবতার নিরিখে, তা না হলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বিভ্রান্তি মানুষের ক্ষেত্রে যেমন, নিজের ক্ষেত্রেও। কারণ, প্রাক্কলনের ভিত্তিতে নীতি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা চলে না।
জাহিদ হোসেন বলেন, আমদানির প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ ঋণাত্মক ধরা হলো, আবার বলা হলো জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। উৎপাদনের সঙ্গে তো আমদানির সম্পর্ক আছে। আমদানি কম হলে প্রবৃদ্ধি হবে কীভাবে?
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এদিকে আগামী ২২ মার্চ থেকে রমজান মাস শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলন অনুযায়ী, এ সময় প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের চাহিদা প্রায় দেড় গুণ হয়ে যায়। সেই হিসাবে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসজুড়ে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা বাড়বে। এ সময় বাড়তি ডলারেরও দরকার হবে ব্যবসায়ীদের।
তবে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে আগামী জুন পর্যন্ত ১৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া যাবে বলে সরকার আশা করছে। এর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি ডলারের প্রথম কিস্তি ৩৫ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংক থেকে ২৫ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৫০ কোটি ডলার ও জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) থেকে ৩৫ কোটি ডলার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তো রিজার্ভ বাড়েনি। দ্বিতীয় ছয় মাসে কীভাবে এত বাড়বে, তা বোধগম্য নয়। সরকার যা আশা করছে, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো থেকে ডলার পাওয়া যাবে তার অর্ধেকেরও কম।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, শুধু রিজার্ভ নয়, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় নিয়েও সরকারের প্রত্যাশা বাস্তবতা থেকে বেশি। আবার আমদানির প্রাক্কলন ৯ শতাংশ ঋণাত্মক, অথচ প্রথম ছয় মাসের আমদানি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ বাড়িয়ে প্রাক্কলন করলে সরকারের নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হয় এবং সব জায়গায় ভুল বার্তা যায়। সে জন্য অবাস্তব প্রাক্কলন থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেন সেলিম রায়হান।