স্বাধীনতার পর ৫২ বছরেও বিনিয়োগ নীতি হয়নি: মাশরুর রিয়াজ

‘অর্থনীতি: নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ। আজ শনিবারছবি: প্রথম আলো

দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। বিনিয়োগ আনার জন্য সেভাবে আদৌ চেষ্টা করা হচ্ছে কি না, তা নিয়েও কথা আছে। স্বাধীনতার পর ৫২ বছরেও কোনো বিনিয়োগ নীতি হয়নি। নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হলেও কবে তা আলোর মুখ দেখবে, সেটি নিশ্চিত নয়।

পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ আজ শনিবার ‘অর্থনীতি: নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন। প্রথম আলো আয়োজিত এই বৈঠকে অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

মাশরুর রিয়াজ বলেন, দেশের বিনিয়োগ আইন অনেক পুরোনো। স্বাধীনতার পর ৫২ বছরেও কোনো বিনিয়োগ নীতিমালা হয়নি। বিনিয়োগ নীতি করার একটা উদ্যোগ মাত্র নেওয়া হয়েছে। কবে তা হবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। বিনিয়োগবান্ধব দু-একটা চিন্তা যে এর মধ্যে করা হয়নি, তা নয়। যেমন ওয়ান–স্টপ সল্যুশন বা এক দরজায় সব সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে এটাকে খুব বড় কোনো বিষয় নয় বলে মনে করেন মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, এগুলোর জন্য কেউ সেভাবে বিনিয়োগ থামিয়ে রাখে না। খাতভিত্তিক সনদ দেওয়ার মতো বিষয় বাধাগ্রস্ত হলে তখন বিনিয়োগ আসে না। এ ছাড়া দেশের পরিবহনব্যবস্থায় গতি কম, যা বিনিয়োগের জন্য ভালো বিষয় নয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডরে ট্রাকের গতি ঘণ্টায় মাত্র ১৯ কিলোমিটার। এটা ন্যূনতম ৪০ কিলোমিটারে উন্নীত করতে হবে। পণ্য রপ্তানিতে গতি আনতে হবে।

মাশরুর রিয়াজ বলেন, টাকা পাচার অনেক বেড়ে গেছে। এর বড় অংশ বেনামি ঋণ ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের টাকা। মূল্য বাড়িয়ে বা কমিয়ে আমদানি-রপ্তানি করার মাধ্যমেও টাকা পাচারের ঘটনা ঘটছে। কয়েকটা ব্যাংক এখন একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পথে। এগুলোর জন্য ব্যাংক খাতে মার্জার (একীভূত) ও অ্যাকুইজিশনের (অধিগ্রহণ) অনুমতি দেওয়ার সময় এসেছে। নতুন মুদ্রানীতির কিছু সিদ্ধান্তও বিপরীতমুখী হয়েছে। রিজার্ভের ওপরে চাপ আছে। ১২৩ টাকার নিচে ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাচ্ছে না। তবে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। অন্যথায় কোনো উদ্যোগ আলোর মুখ দেখবে না।

কর ব্যবস্থাপনাকে দেশের একটি বড় সমস্যা উল্লেখ করে মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক কম। এটা বাড়ানোর তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। অনেক দিন ধরে এটা নিয়ে কথা হলেও কার্যত কোনো অগ্রগতি নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শুধু কর সংগ্রহ করার কাজ করলে হবে না। তাদের কাজ হওয়া উচিত বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু তারা কর সংগ্রহের কাজটাই কতটুকু করতে পারছে, তা সবাই জানে। এ ছাড়া ন্যূনতম কর, করছাড় ও দ্বৈত করের মতো বিষয়গুলোতে নানা অসংগতি আছে। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে এগুলোর সমাধান হওয়া জরুরি।’

আগামী কয়েক দশক ডিজিটাল অর্থনীতির সময় বলে মনে করেন মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন এবং লেদারে (চামড়া) ১০ বিলিয়ন ডলার করা সম্ভব। কিন্তু সেটা ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে আছে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, নতুন সরকার এসেছে। সরকার আসলে নতুন নয়। নির্বাচনের মাধ্যমে একই সরকার এসেছে। কয়েকজন ছাড়া নীতিনির্ধারকদেরও অনেকেই পুরোনো। অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো নতুন নয়। আবার চ্যালেঞ্জগুলোর সূত্রপাতও নতুন নয়।

এ মুহূর্তে প্রবৃদ্ধির চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে উল্লেখ করে মাশরুর রিয়াজ বলেন, এখন দরকার আর্থিক স্থিতিশীলতা। তবে আমাদের সংস্কারপ্রক্রিয়া দুর্বল। কারণ, এখানে টেকনিক্যাল (কৌশলগত) আলোচনা কম হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে মজবুত অবস্থানে নিয়ে যেতে গেলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা—মোটাদাগে এই তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সবকিছুর ওপরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, অনিশ্চয়তা। এটা দূর করা না গেলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়।