অর্থনীতির যেসব খাতে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল ভয়াবহ রকমের বৈষম্য। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন না করে পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রাধান্য দিয়েছিল। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে এ দেশের মানুষ ক্রমেই পিছিয়ে যেতে থাকে। চাকরি বা ব্যবসার সুযোগও ছিল সীমিত।

ফলে বাঙালির আয় কিংবা সম্পদ বাড়ানোর সুযোগ কম ছিল। শিল্পায়ন হয়নি বললেই চলে। অর্থনৈতিক বিবেচনায় পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান শুধু বেড়েই চলছিল।

তবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ অনেক দেশের কাছে অনুকরণীয়। মাথাপিছু আয়, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। পাঁচ বছর আগেই মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। রপ্তানি আয় পাকিস্তানের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। রিজার্ভ পৌনে ছয় গুণ বেশি। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি এখন ২৭ শতাংশ, বাংলাদেশে পৌনে ৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গেমচেঞ্জার হলো পল্লি এলাকায় রাস্তাঘাট, সেতুসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ। এসব অবকাঠামোই গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙা করেছে, যা সার্বিকভাবে আয় বাড়াতে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া নব্বইয়ের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একধরনের স্থিতিশীলতা ছিল। কৃষি, বাণিজ্য উদারীকরণ, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে কোনো সরকার সংস্কার করলে পরের সরকার এসে তা উল্টে দেয়নি।
জাহিদ হোসেন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পাকিস্তানের তুলনায় বেশি সুসংহত বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এক বছর ধরে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান যে বড় ধরনের আর্থিক সংকটে ভুগছে, সেই তুলনায় বাংলাদেশ ভালো আছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সব সময় কমবেশি অস্থিরতা ছিল। দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে এটি কোনোভাবেই সাহায্য করেনি। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একধরনের স্থিতিশীলতা ছিল, যা অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পেরেছে। এই পার্থক্যই বাংলাদেশকে এগিয়ে দিয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গেমচেঞ্জার হলো পল্লি এলাকায় রাস্তাঘাট, সেতুসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ। এসব অবকাঠামোই গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙা করেছে, যা সার্বিকভাবে আয় বাড়াতে সহায়তা করেছে।

প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া নব্বইয়ের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একধরনের স্থিতিশীলতা ছিল। কৃষি, বাণিজ্য উদারীকরণ, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে কোনো সরকার সংস্কার করলে পরের সরকার এসে তা উল্টে দেয়নি, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ধারাবাহিকতা এনেছে। ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সংস্কারের ‘স্বর্ণ সময়’ বলা যায়। এর সুফল আমরা এখনো ভোগ করছি।’

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, পাকিস্তানে সামরিক সরকার বারবার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আটকে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তও সেনাবাহিনী নিয়েছে, যা পাকিস্তানকে পিছিয়ে দিয়েছে।

পাঁচ বছর আগেই পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ

স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৮০ টাকা, যা তৎকালীন ৯৪ মার্কিন ডলারের সমান। মাথাপিছু আয় ৫০০ ডলার ছাড়াতে ৩১ বছর সময় লাগে বাংলাদেশের। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় হয় ৫১০ ডলার। এক হাজার ডলার পেরোতে স্বাধীনতার পর থেকে ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫৪ ডলার। পরের সাত বছরেই তা দ্বিগুণ হয়ে যায়।

দ্রুত বাড়তে থাকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সঙ্গে বাড়ে মাথাপিছু আয়। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়কে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। ওই অর্থবছরে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় হয় ১ হাজার ৪৫৯ ডলার। ওই বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫১ ডলার। এভাবেই স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের লড়াইয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৯৩ ডলার। স্বাধীনতার পর মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ।

পাকিস্তান ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (পিবিএস) তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশটির মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি কখনো স্থিতিশীল ছিল না। কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। পুরো সত্তরের দশকের সময়টি তাদের লাগে ২০০ ডলার থেকে মাথাপিছু আয় ৩০০ ডলারে উন্নীত হতে। আশির দশকজুড়ে মাথাপিছু আয় বাড়ে আরও এক শ ডলার। ওই দুই দশক সামরিক শাসনের আধিপত্য ছিল। নব্বইয়ের দশকেও মাথাপিছু আয় কখনো কমেছে, কখনো বেড়েছে, ছিল সামরিক সরকারও।

২০০০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয় বেড়ে হাজার ডলার পেরোয়। আর গত দশ বছরে তা বেড়েছে মাত্র ৫০০ ডলারের কিছুটা বেশি। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৪৩ ডলার। এভাবেই পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে কখনোই স্থিতিশীলভাবে অগ্রগতি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বারবার সামরিক শাসন বা সেনানির্ভর সরকারব্যবস্থার কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ধারাবাহিকতা আসেনি।

রপ্তানি আয় বেশি ৬০%

রপ্তানি আয়েও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন পোশাক রপ্তানিতে সারা বিশ্বে দ্বিতীয়। সব মিলিয়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান গত অর্থবছরে ৩ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এখন ৬০ শতাংশ বেশি।

মূল্যস্ফীতিতে বেশি ভুগছে পাকিস্তান

কোভিড মহামারি ও এর পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং ইউক্রেন যুদ্ধ—এসব কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ও উৎপাদন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমে যাওয়ার কারণেও মারাত্মক সমস্যায় পড়ে অনেক দেশ। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানও এর ব্যতিক্রম নয়। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ আছে দুই দেশেই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশে। গত ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় অপরিবর্তিত আছে। তবে কোনোটিই দুই অঙ্কের ঘরে নেই।

অন্যদিকে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি এখন অতিমাত্রায় বেশি। মূল্যস্ফীতির চাপে পাকিস্তানের মানুষ পিষ্ট। গত ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৭ শতাংশ। দেশটির গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ৩৫ শতাংশ, শহরে ২৩ শতাংশের মতো ও গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ৪৭ শতাংশ।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পৌনে ৬ গুণ বেশি

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিষয়টি এখন দুই দেশেই আলোচিত হচ্ছে। ডলার–সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি মূল্যে পণ্য আমদানি করতে গিয়ে রিজার্ভে টান পড়েছে সবার। তবে পাকিস্তানের রিজার্ভ ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। পাকিস্তানের সর্বশেষ হিসাবে গত ফেব্রুয়ারি শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪৫ কোটি ডলারে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় পৌনে ছয় গুণ বেশি রিজার্ভ আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার। বছর খানেক আগেও বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছিল। আর্থিক খাতের ভারসাম্য রক্ষাসহ অর্থনৈতিক চাপ সামলাতে দুটি দেশই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয়েছে।

বাংলাদেশে এক ডলার কিনতে মোটামুটি ১০৫ টাকা খরচ করতে হয়। এক বছর আগে দাম ছিল ৮৬ টাকা। অন্যদিকে পাকিস্তানে ডলারের দাম ২৫৯ রুপি। এক বছর আগে দাম ছিল ১৭৬ রুপি। দুই দেশেই ডলারের দাম বেড়েছে, অর্থাৎ স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে।

শুধু প্রবাসী আয়ে এগিয়ে পাকিস্তান

প্রবাসী আয়ে শুধু এগিয়ে আছে পাকিস্তান। মূলত দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিকদের পাঠানো অর্থই পাকিস্তানকে এই খাতে এগিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ থেকে তুলনামূলক কম দক্ষ শ্রমিক বেশি বিদেশে যান। ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে পাকিস্তানে প্রবাসী আয় এসেছে ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। আর বাংলাদেশে আসা প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। অবশ্য কোভিডসহ নানা কারণে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমেছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বৈষম্যের কারণে পাকিস্তান থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা আলাদা হয়েছি। এখন মাথাপিছু আয়, রপ্তানি আয়সহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে তাদের ছাড়িয়ে যাওয়ায় আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। কারণ, আমরা যখন স্বাধীনতা লাভ করেছি, তখন চীন ও ভিয়েতনাম আমাদের কাতারের দেশ ছিল। আজ তারা কোথায় এগিয়ে গেছে। তাই অর্থনীতিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে সংস্কার প্রয়োজন।’