ফুটপাতের ব্যবসায় মন্দা, বিক্রি ভালো ব্র্যান্ডের দোকানের

রাজধানীর নিউমার্কেটে শেষ মুহূর্তে ঈদের পোশাক কেনাকাটা করছেন ক্রেতারা। গতকাল বৃহস্পতিবার তোলা ছবিপ্রথম আলো

নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানের উল্টো পাশে নিউমার্কেটের ফটক দিয়ে ঢুকলেই মোহাম্মদ শহীদের অস্থায়ী দোকান। ১০০ টাকা দরে বাহারি রঙের ওড়না বিক্রি করেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়, তখন তিনি ছোট্ট একটি টুলে অলস বসে ছিলেন। কারণ, ক্রেতার চাপ নেই।

ঈদের বেচাকেনা কেমন প্রশ্ন করতেই মোহাম্মদ শহীদ বলেন, ‘এখানে ৪০ বছর ধরে ব্যবসা করছি। করোনার দুই বছর ছাড়া বাকি ৩৮ বছরে কখনো এত খারাপ ব্যবসা হয়নি। গত বছরও ২০ রমজানের পর থেকে চাঁদরাত পর্যন্ত প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেছি। সেখানে গত বুধবার বিক্রি করেছি মাত্র ১১ হাজার টাকা। বৃহস্পতিবারও ক্রেতা নেই।’

মোহাম্মদ শহীদের মতো নিউমার্কেটের আরও কয়েকজন অস্থায়ী দোকানি জানান, এবার ঈদের বেচাবিক্রি জমেনি। একই কথা জানান, গুলিস্তানের ফুটপাতের ব্যবসায়ীরাও। উভয় জায়গাতেই গতকাল দুপুরের দিকে ক্রেতার আনাগোনা ছিল কম। ফুটপাত থেকে মূলত নিম্ন আয়ের মানুষেরা কেনাকাটা করেন।

গুলিস্তান ও নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। তাই তারা পোশাক কিনছেন কম। যেটুকু না হলেই নয়, সেটুকুই কিনছেন।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত মার্চে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তার মানে, ২০২২ সালের মার্চে চাল, ডাল, তেল, নুন, পোশাক, বাসাভাড়া, যাতায়াতসহ জীবনযাপনের খরচ চালাতে যদি ১০০ টাকা খরচ হতো, তাহলে এ বছরের মার্চে সেই খরচ বেড়ে হয়েছে ১০৯ টাকা ৩৩ পয়সা।

ফুটপাতের ঈদের পোশাকের ব্যবসায় মন্দাভাব থাকলেও নামীদামি ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকানে বিক্রি মোটামুটি ভালো। যদিও কোনো কোনো ব্র্যান্ডের বিক্রি প্রত্যাশানুযায়ী না হওয়ায় ১৫ রোজার পর থেকে মূল্যছাড় দিচ্ছে। অন্যদিকে বুটিক শপের কারও কারও বিক্রি গত বছরের তুলনায় কম হয়েছে।

ঢাকার নিউমার্কেটে মোহাম্মদ শহীদের সঙ্গে কথা বলার আগে ওই এলাকার মূল সড়কের ফুটপাতে আসিফ হাসান নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘৮০ হাজার টাকার পোশাক কিনেছিলাম। বুধবার ১ হাজার ২০০ টাকা ও মঙ্গলবার ৩ হাজার টাকার পোশাক বিক্রি করেছি। অথচ এক দিন দোকানদারি করতে খরচ হয় ৭০০-৮০০ টাকা। সেই খরচই কোনো কোনো দিন তুলতে পারছি না। কারণ, সস্তা পোশাকে লাভ কম।’ আসিফ হাসান জানান, বেচাবিক্রি কম হওয়ায় তাঁর পাশের একজন ব্যবসায়ী এবার দোকানই বসাননি।

নিউমার্কেটের আগে গতকাল সকাল ১২টার দিকে গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতের দোকানগুলোতে অল্পসংখ্যক ক্রেতা থাকলেও কোনো ভিড় নেই। গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টায়ও এই এলাকায় ক্রেতার ভিড় দেখা যায়নি।

গুলিস্তানে নজরুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী ১৫০ টাকা দরে পলো টি–শার্ট বিক্রি করছিলেন। ঈদের বিক্রি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যবসা খুব খারাপ। গত বছর ২৫ রোজার পর থেকে প্রতিদিন ২০০-২৫০ পলো টি–শার্ট বিক্রি করেছি। এবার ৩ ভাগের ১ ভাগও হচ্ছে না। বুধবার বিক্রি করেছি মাত্র ৭০টি পলো টি–শার্ট।

পাশেই আরেকটি দোকানে ২০০-৮০০ টাকা দরে ছেলেদের জিনসের প্যান্ট বিক্রি করছিলেন শরীফ হোসেন। তিনি বলেন, গত বছর ২০ রোজার পর দিনে গড়ে ৭০ হাজার টাকার প্যান্ট বিক্রি করেছি। এবার অর্ধেকও বিক্রি হচ্ছে না।

রাজধানীর নিউমার্কেটে শেষ মুহূর্তে ঈদের পোশাক কেনাকাটা করছেন ক্রেতারা। গতকাল বৃহস্পতিবার তোলা ছবি
প্রথম আলো

গুলিস্তান কিংবা নিউমার্কেটের ফুটপাতে কম দামের যেসব পোশাক বিক্রি হয়, তার একটি অংশের জোগান আসে কেরানীগঞ্জ ও ইসলামপুরের পাইকারি বাজার থেকে। সেখানকার ব্যবসায়ীরাও বলছেন, শবে বরাতের পর বেচাবিক্রি জমলেও রোজার শুরুতে ব্যবসা কমে যায়। শেষপর্যন্ত গতবারের চেয়ে এবার বিক্রি কম হয়েছে।

কেরানীগঞ্জে ১০ হাজার পোশাকের দোকান রয়েছে। আর ছোট কারখানার সংখ্যা পাঁচ হাজার। এসব কারখানায় জিনস থেকে শুরু করে বাচ্চাদের পোশাক বেশি তৈরি হয়। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুসলিম ঢালি প্রথম আলোকে বলেন, রোজার সময় থেকে সারা দেশের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে কয়েক দফায় পোশাক কেনেন। একবার কিনে নিয়ে বিক্রি করে আবার আসেন। অন্যবারের মতো এবারও শবে বরাতের পর বাজার জমে উঠেছিল। কিন্তু রোজার শুরুতে ব্যবসা পড়ে যায়। তারপর আর জমেনি। আমাদের ধারণা, গতবারের চেয়ে ব্যবসা ২০-২৫ শতাংশ কম হয়েছে।

অন্যদিকে ইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেসার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আমাদের হিসাবে গতবারের তুলনায় অন্তত ৪০ শতাংশ ব্যবসা কম হয়েছে। ব্যবসা কেন খারাপ জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি।

এদিকে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার আগে রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতানে ব্র্যান্ডের পোশাকে ক্রেতার ভিড় দেখা গেছে। তবে গতকাল বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, এলিফ্যান্ট রোডের বিভিন্ন ব্র্যান্ডশপের দোকানে ক্রেতার তেমন ভিড় ছিল না।

দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ডের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে আড়ং। ১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরু করা এই ব্র্যান্ডের সারা দেশে বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ২৭। বিক্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি অনলাইনেও দেশে-বিদেশে পণ্য বিক্রি করছে তারা।

জানতে চাইলে আড়ংয়ের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মোহাম্মদ আশরাফুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছর ঈদের বেচাকেনা বেশ উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। হঠাৎ কোনো কোনো দিন বিক্রি কমে যাচ্ছিল। আমাদের প্রত্যাশা, শেষ পর্যন্ত গতবারের চেয়ে ১৫ শতাংশ বিক্রি বেশি হবে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক টিম গ্রুপের দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ডের নাম ‘টুয়েলভ’। বর্তমানে সারা দেশে তাদের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৩৮। টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, গত এক বছরে আমাদের নতুন বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা আটটি বেড়েছে। আশা করছি, এবার ঈদের বিক্রি গতবারের চেয়ে ৩৫-৪০ শতাংশ বাড়বে।  

পোশাকের আরেক জনপ্রিয় ব্র্যান্ড সেইলরের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) রেজাউল কবীর বলেন, আমাদের বিক্রি প্রত্যাশার চেয়ে ভালো। শেষ পর্যন্ত গতবারের চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ বেশি বিক্রি হবে।  

দেশজুড়ে সারা লাইফস্টাইলের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ১১। গত বছর তাদের বিক্রয়কেন্দ্র ছিল সাতটি। জানতে চাইলে সারা লাইফস্টাইলের হেড অব অপারেশন মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রোজার শেষ দিকে এসে বিক্রি কিছুটা ভালো হচ্ছে। তাতে আশা করছি, গতবারের তুলনায় ২৫-৩০ শতাংশ বেশি বিক্রি হবে।

অবশ্য বুটিক শপের ব্যবসা আশানুরূপ হয়নি বলে জানান রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গতবারের চেয়ে বিক্রি ১৫-২০ শতাংশ কম হবে। এবার ক্রেতাদের বাজেট কম। তার বড় কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি।