‘নোট না নিলে বই দেবে না’, বিদেশি ঋণ নিয়ে এই অবস্থা চলছে
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে কম সুদে ঋণ নেওয়ার কারণে পরামর্শক নিয়োগসহ বিভিন্ন শর্ত মানতে হয়। এতে সময় ও অর্থের বড় ধরনের অপচয় হয়। তাদের শর্ত অনুসারে পরামর্শক না নিলে আবার ঋণ দেয় না। অনেকটা বই কিনলে সঙ্গে নোটও নিতে হবে, এমন অবস্থা।
আজ শনিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বিষয়ে এই সেমিনারের আয়োজন করে আইসিসিবি।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়ই সময় ও অর্থের বড় ধরনের অপচয় হয়। তারপরও লেনদেনের শর্তের খাতিরে অনেক সময় বাধ্য হয়ে পরামর্শক নিতে হয়।
এ সময় উদাহরণ টেনে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘অনেক সময় বই কিনলে নোটও কিনতে হয়। কারণ, নোট না নিলে বই দেবে না। তেমনি (ঋণ প্রদানকারী সংস্থা) ঋণ দেবে না, যদি ওই পরামর্শক না নিই। এটা লুকানোর কোনো বিষয় নয়। যেহেতু আমরা কম সুদে ঋণ নিই, এ জন্য ওই প্রক্রিয়ায় সেমিনার, ভিজিট, কনসালট্যান্ট, মিশনসহ বিভিন্ন ফাঁদ থাকে।’
এম এ মান্নান বলেন, ‘সংস্থাগুলো লোনের বাংলা করেছে সহায়তা। তবে লোনের বাংলাকে আমরা এখন ঋণই বলব। প্রধানমন্ত্রীও বারবার এ কথা বলেছেন। এবার বিশ্বব্যাংকের অনুষ্ঠানেও তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, “আমরা টাকা নিই, আবার ফেরত দিই। সুদে-আসলে ফেরত দিই। আমরা কখনো ব্যর্থ হইনি। আমরা কথা রেখেছি। তাহলে কেন একের পর এক নানা ধরনের শর্ত দিয়ে যাচ্ছেন। আপনারা এসব শর্ত কমান, ওয়ান টু ওয়ান কথা বলেন।”’
আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরী, আইসিসিবির সহসভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে আজাদ, আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক এম শামসুল হক।
‘ব্যবসায় প্রধান বাধা এনবিআর’
অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সমালোচনা করে অ্যামচেম সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের মতো এত অকার্যকর শুল্ক বিভাগ (কাস্টমস) বিশ্বের আর কোথাও নেই। ব্যবসার ক্ষেত্রে কেউ যদি প্রধান বাধা হয়, সেটা এনবিআর।
আইসিসিবির সহসভাপতি এ কে আজাদ বলেন, তিনি মনে করেন যে প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং সরকারের প্রতিটি জায়গায় জবাবদিহি নিশ্চিত করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি (এনবিআর) বিপদের সময় সরকারকে অর্থের জোগান দেয়। এই অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া সব সময় যে আনন্দ নিয়ে করে, এমন নয়। অনেক সময় কষ্ট দিয়েই করে। তবে আমি বলব, এনবিআরের সমস্যাটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, নিয়মকানুনকেন্দ্রিক।’
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘ব্রিটিশরা অনেক বাঁকা নিয়মকানুন তৈরি করে গেছে। পাকিস্তান আমলেও সেগুলো ছিল। আমরাও শুরুতে এসব বুঝতে পারিনি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এসব বাঁকা নিয়মকানুনের পরিবর্তন না হবে, ততক্ষণ সমস্যা থাকবে।’
এসব ব্যবস্থা সংস্কারে সরকারপ্রধান ইতিবাচক রয়েছেন, এমন কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সময় লাগবে। ইতিমধ্যে অনেক নিয়ম সহজ করা হয়েছে। বাকিগুলোও ধীরে ধীরে করা হবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম উড়াল মহাসড়কের পরামর্শ
স্বাগত বক্তব্যে আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে বিদ্যমান চার লেনের সড়ক দিয়ে যানবাহনের বাধাহীন চলাচল সম্ভব হচ্ছে না। সড়কটি আট লেন করা হলেও এই সমস্যা কাটবে না। আমরা বর্তমানে বড় ধরনের বিনিয়োগ ও রপ্তানির লক্ষ্যে এগোচ্ছি। এ জন্য ওই পথে উড়াল মহাসড়ক একটি টেকসই সমাধান হতে পারে। এতে পণ্য পরিবহনের গতি বাড়বে এবং জ্বালানিসহ বিভিন্ন খরচ সাশ্রয় হবে।
হা-মীম গ্রুপের এমডি এ কে আজাদ বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম উড়াল মহাসড়ক এখন আমাদের অগ্রাধিকার নয়। আমাদের এখন সংযমী হতে হবে। দেশের রপ্তানির গতি কমেছে। যদি যুদ্ধ বন্ধ না হয়, তাহলে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এ অবস্থা থাকতে পারে। ফলে এ সময় সরকারের হাতে নতুন কোনো বড় প্রকল্প নেওয়ার সময় নেই।’
এ কে আজাদ বলেন, যেসব প্রকল্পের ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে, সেগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে এবং অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এ সময় তিনি আমদানি-রপ্তানির গুরুত্ব বিবেচনা করে দ্রুত গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ শেষ করার পরামর্শ দেন।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক এম শামসুল হক বলেন, বাংলাদেশে মালামালের সরবরাহ খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। পণ্য উৎপাদন খরচের ৪০ শতাংশের মতো যায় কেবল পরিবহন খাতে। এটা কমাতে হলে এক্সেস কন্ট্রোলড (প্রবেশাধিকার এবং গাড়ির লেন নির্দিষ্ট) মহাসড়ক নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ জন্য উড়াল মহাসড়ক একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।
এম শামসুল হক বলেন, বর্তমানে বেশির ভাগ প্রধান মহাসড়কে গাড়ির গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। কিন্তু এক্সেস কন্ট্রোলড সড়কের মাধ্যমে এটিকে ৮০ কিলোমিটারে নিয়ে যাওয়া গেলে দেশের রপ্তানি ৬-৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
উড়াল মহাসড়ককে পরিবেশ সুরক্ষা ও খরচ সাশ্রয়ী উল্লেখ করে এম শামসুল হক বলেন, সাধারণ সড়কের জন্য অনেক পরিমাণে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হয়। আর সড়কের দুই পাশে আরও তিন গুণ বেশি জায়গা লাগে। কিন্তু উড়াল মহাসড়ক হলে এভাবে জায়গা নষ্ট হবে না। পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণের খরচও অনেক কমে যাবে।