অর্থমন্ত্রী যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে, আসবে আইএমএফ

১০ থেকে ১৬ অক্টোবর ওয়াশিংটনে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলন। বাংলাদেশের ঋণ চাওয়া এবং শর্ত নিয়ে আলোচনা হবে।

  • অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে চায় ৪৫০ কোটি ডলার।

  • আইএমএফের ঋণ সব সময়ই শর্তযুক্ত থাকে। আলোচনা যেহেতু শুরু হয়নি, তাই শর্তগুলো এখনো অস্পষ্ট।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল
ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য শর্ত পূরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে। আর দেড় মাস পর—আগামী ১০ থেকে ১৬ অক্টোবর সময়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের যে বার্ষিক সম্মেলন বসছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে, সেখানে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঋণ পাওয়ার জন্য অর্থনীতির বর্তমান চিত্র বিশদভাবে সম্মেলনের সময় অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সংস্থাটিকে তখন অনুরোধ করা হবে সম্মেলন শেষেই যেন ঋণের আলোচনা শুরু করতে তাদের একটি মিশন বাংলাদেশ সফরে আসে।

অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন দলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমও সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা।

ওয়াশিংটনে আলোচনা সফল হলেই সংস্থাটির মিশন আসবে বাংলাদেশ সফরে। আইএমএফ মিশন বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ, এনবিআরসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে।

‘আইএমএফের স্টাফ মিশন বিবৃতিতে যেসব কথা বলেছে, আইএমএফের শর্তগুলোর মধ্যে এগুলোই থাকবে। নতুন করে কোনো শর্ত আরোপের কিছু নেই-ও। সরকার এগুলো পূরণ করলে বা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলে বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ পুরো ঋণ পাবে, নইলে সামান্য শর্ত পূরণ করে ১৫০ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।’
আহসান এইচ মনসুর, আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ নিয়ে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়াশিংটনে আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলনে আমি এবার যাচ্ছি এবং আইএমএফের সঙ্গে ওখানেই আমার প্রথম আলোচনা হবে। আমরা ঋণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরব। তবে আমি দেখেছি যে আইএমএফ যেসব শর্ত দেয়, সেগুলো খারাপ না।’

আইএমএফ

খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক খাতে ঋণের সুদ কমাতে বলবে আইএমএফ, এ শর্ত কি পূরণ করবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘তারা তাদের কথা বলবে, আমরা দর–কষাকষি করব। তাদের সবকিছুতে রাজি না-ও হতে পারি। যেমন ঋণের সুদ ৯ শতাংশ না হলে কোনো শিল্পের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এ শর্ত কীভাবে মানব?’

কত ঋণ চায় বাংলাদেশ

আইএমএফ থেকে সরকার কত ঋণ চায়, তা এখনো জানানো হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে চায় ৪৫০ কোটি ডলার। ওয়াশিংটনে আলোচনা সফল না হলে অর্থাৎ বাস্তবায়ন করতে চায় না, এমন কোনো শর্ত আইএমএফ দিলে বাংলাদেশ আইএমএফের রেজিলিয়ান্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ট্রাস্ট (আরএসএফটি) তহবিল থেকে নিতে চাইবে শুধু ১৫০ কোটি ডলার। এ তহবিল থেকে ২০ বছর মেয়াদে ঋণ দেয় আইএমএফ, যার গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর। এ তহবিল থেকে ঋণ নিলে কঠিন কোনো শর্ত পূরণ করতে হয় না।

আইএমএফের ঋণ সব সময়ই শর্তযুক্ত থাকে। আলোচনা যেহেতু শুরু হয়নি, তাই শর্তগুলো এখনো সরকারের কাছে অস্পষ্ট। গত মাসে ১২ দিনের জন্য সংস্থাটির একটি স্টাফ মিশন আসে ঢাকায় এবং সেই মিশন চলে যাওয়ার পর দুই পৃষ্ঠার একটি সমাপনী বিবৃতি দেয় আইএমএফ।

রাজস্ব খাতে সংস্কার, বিশেষ করে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কমানো, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, ভর্তুকি কমানোসহ বিবৃতিতে মোট ৯টি বিষয় উঠে আসে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, স্টাফ মিশনের বিবৃতির সঙ্গে আইএমএফের ঋণের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আইএমএফ বরাবরই বাংলাদেশের যেসব বিষয়ে কথা বলে আসছে, তার সবগুলোই রয়েছে এতে। সে হিসেবে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে এ বিবৃতিই প্রস্তুতি নেওয়ার একটা ইঙ্গিত বলে মনে করছে বাংলাদেশ।

আইএমএফকে গত মাসে দেওয়া চিঠিতে বাংলাদেশ বলেছিল, দেশে এত দিন একটা টেকসই সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থাই ছিল। দারিদ্র্যের হার কমেছে। বেড়েছে গড় আয়ু ও সাক্ষরতার হার। তবে এখন সময় একটু খারাপ (ক্রিটিক্যাল টাইম)। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। বিশ্ববাজারে অভূতপূর্ব হারে বেড়ে গেছে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও নিত্যপণ্যের দাম। আমদানিতে হয় নাটকীয় উত্থান। চলতি হিসাবেও ব্যাপক ঘাটতি।

আরও বলা হয়, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), কয়লা, চাল, গম, ভুট্টা, সার, পাম তেল ও সয়াবিন তেল আমদানিতে বাড়তি গুনতে হয়েছে ৭৬০ কোটি ডলার। প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। জরুরি ভিত্তিতে লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখা ও বাজেট-সহায়তা বাবদ তাই বাংলাদেশের অর্থের দরকার।

আইএমএফ কী চায়

আইএমএফের স্টাফ মিশন রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছে। বলেছে, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার এখনো নিম্ন। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ ছাড়া মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হারের কাঠামো সহজ করা, কর প্রশাসন আধুনিক করা এবং বড় করদাতাদের দিকে নজর দেওয়া দরকার। সরকার চাইলে এ ব্যাপারে আইএমএফের কারিগরি দল সহায়তা করতে পারে। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল চালু ও তা বাস্তবায়ন করাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে আইএমএফ।

জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার যে অর্থ সংগ্রহ করে, তা সরাসরি বাজেট থেকে আলাদা করতে চায় আইএমএফ। সংস্থাটি আরও চায় জ্বালানি তেলের দামের বিষয়ে ধীরে ধীরে নতুন কৌশল বা পদ্ধতি চালু করা।

এটা করতে পারলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে বেশিসংখ্যক গরিব মানুষকে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে। সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা, সরকারি বিনিয়োগ কাঠামো, রাজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং মধ্যমেয়াদি ঋণ কৌশলপত্রের সংস্কার চায় আইএমএফ।

আইএমএফ বেঁধে দেওয়া ঋণের সুদের হার (৯ শতাংশ) তুলে দেওয়া এবং এই সময়ে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পক্ষে। সংস্থাটি বলেছে, এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে। মার্কিন ডলারের তুলনায় টাকার মান কমানোর সাম্প্রতিক উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আইএমএফ বলেছে, এতে ডলারের তারল্য পরিস্থিতি ভালো হবে।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে চায় আইএমএফ। বিশেষ করে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে। বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, ১০টি দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুক্তি করছে ভালো।

তবে সার্বিক খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হলে পুরো ব্যাংক খাতে নজরদারি বাড়াতে হবে, খেলাপি ঋণ কমাতে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে এবং খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে সুশাসন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতি বিলম্বে সংরক্ষণের যে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তা বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।

সরকার যে প্রস্তুতি নিচ্ছে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো মনে করছে, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার এরই মধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে আইএমএফের মনোভাব ইতিবাচক থাকবে। এগুলো হচ্ছে মুদ্রাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রা বিনিময় হার শিথিল করা, বিলাসপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করা, সরকারি গাড়ি কেনা স্থগিত করা, কম জরুরি প্রকল্পে বরাদ্দ স্থগিত করা, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারি অফিসের সময়সূচি বদলানো, ইত্যাদি। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানোর জন্যও সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে কিছু বলা থাকবে।

জানা গেছে, আইএমএফের সঙ্গে যে বিষয়গুলোতে দর–কষাকষি চলবে, সেগুলো হচ্ছে ঋণের সুদের হার তুলে দেওয়া, জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রিকে বাজেট থেকে আলাদা করা এবং রাজস্ব খাতের সংস্কার। সরকার আপাতত এগুলো করতে চায় না, করলেও পরে করবে।

ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সফল হলে আইএমএফের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি করা হবে একটি লেটার অব ইনটেন্ড বা ইচ্ছাপত্র। এ ইচ্ছাপত্রে বলা থাকবে কোন পরিস্থিতিতে সরকার ঋণ নিতে চায় এবং বদলে কোন সময়ের মধ্যে কী কী শর্ত পূরণ করতে চায়। এ ইচ্ছাপত্রে অর্থমন্ত্রীর স্বাক্ষর থাকে সাধারণত। এরপর তা আইএমএফের পর্ষদে উঠবে। পর্ষদ অনুমোদন করলেই মিলবে ঋণ।

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএমএফের স্টাফ মিশন বিবৃতিতে যেসব কথা বলেছে, আইএমএফের শর্তগুলোর মধ্যে এগুলোই থাকবে।

নতুন করে কোনো শর্ত আরোপের কিছু নেই-ও। সরকার এগুলো পূরণ করলে বা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলে বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ পুরো ঋণ পাবে, নইলে সামান্য শর্ত পূরণ করে ১৫০ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।’